ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

সাক্ষাৎকারে কাইনাত ইমতিয়াজ

পাকিস্তানি কন্যার ক্রিকেটে অনুপ্রেরণা কিংবদন্তি ভারতীয় পেসার

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২২
পাকিস্তানি কন্যার ক্রিকেটে অনুপ্রেরণা কিংবদন্তি ভারতীয় পেসার কাইনাত ইমতিয়াজ/ছবি: শোয়েব মিথুন

একাডেমি মাঠে ঘণ্টা দেড়েক অনুশীলন করে কাইনাত ইমতিয়াজ তখন ক্লান্ত। ম্যানেজার বলতেই আর 'না' করলেন না।

মূল মাঠের অনুশীলনে যাওয়ার তাড়ার মধ্যে শোনালেন জীবনের গল্প। সব বৈরিতা ভুলে কীভাবে ভারতের এক ক্রিকেটার অনুপ্রাণিত করলেন তাকে, জানালেন সেটি।

কাইনাত বললেন, 'স্পোর্টস পার্সনরা কখনো মানুষকে আলাদা করে দিতে পারে না। ' শোনালেন মায়ের প্রেরণা, বাবার ত্যাগ, নিজের পড়াশোনার কথা। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।

বাংলানিউজ: ক্রিকেটের শুরুটা কীভাবে হলো?

কাইনাত: ২০০৫ সালের এশিয়া কাপে আমি বল কুড়াতাম। তখন ঝুলন গোস্বামীকে দেখি, সে ভারতীয় পেসার। আমি তার বোলিং, গতি, ব্যক্তিত্ব; সবকিছুতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিকেট খেলার শুরু করি।

বাংলানিউজ: ঝুলনের প্রতি ভালোবাসার কোনো কারণ আছে?

কাইনাত: সে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। অসাধারণ মানুষ তিনি, আমাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন পেস বোলিংয়ের ব্যাপারে। কীভাবে আমি নিয়ম মেনে চলবো। তার ক্যারিয়ার ছিল দুর্দান্ত। আমার মনে হয় সে আমার মতো ক্রিকেটারদের জন্য অনুপ্রেরণা।

ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: দেখা হওয়ার পর কী নিয়ে কথা হলো?

কাইনাত: যখন আমাদের দেখা হয়েছে, সে আমাকে তার জীবন সম্পর্কে বলেছে। কীভাবে নিয়ম মেনে চলে, কোথা থেকে এত শক্তি পায়। আমার কোনো ধারণা ছিল না যে সে মজা করতে পারে, কিন্তু সে খুব বিনয়ী ও মজার মানুষ। খুব বেশিক্ষণের জন্য তার সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু যতক্ষণ কথা বলেছি; উপভোগ করেছি।

বাংলানিউজ: ঝুলনকে নিয়ে আপনার একটা স্ট্যাটাস তো ভাইরালও হয়েছিল...

কাইনাত: হ্যাঁ, সে অনেক বছর ধরে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তার সঙ্গে একই মাঠে খেলতে পারার স্বপ্নও দেখেছি বহুদিন। যখন এটা পূরণ হয়েছে, নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে। তার সঙ্গে আমি মাঠে খেলছি, এটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না!

এটা নিয়েই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, পরে ভাইরাল হয়ে গেছে। সে অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমি তাদের একজন হতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।    

বাংলানিউজ: পাকিস্তানি হয়েও ভারতের একজনকে এমন ভালোবাসা কঠিন নয় কি?

কাইনাত: কোনোভাবেই আমি এমন মনে করি না। এখানে কঠিনের কিছু নেই। আপনি যেকোনো ক্রিকেটারকেই ভালোবাসতে পারেন। আমরা ভারতের ছেলে ক্রিকেটারদেরও পছন্দ করি। একজন স্পোর্টস পার্সন কখনো মানুষকে আলাদা করতে পারে না। আমরা সবাইকে তাদের খেলার কারণে স্বীকৃতি দিয়ে থাকি, পছন্দ করি, ভালোবাসি।

বাংলানিউজ: পেসার হলেন কেন?

কাইনাত: ঝুলন গোস্বামীর প্রতি এমনিতে তো মুগ্ধতা ছিলই। তার ওপর ওয়াসিম আকরাম ছিলেন ওই টুর্নামেন্টের প্রধান অতিথি। মানে চারদিকে শুধু পেসার আর পেসার। আমিও তাই পেস বোলিং শুরু করি। এখন অবশ্য আমি অলরাউন্ডার। কিন্তু শুরুতে শুধু পেস বলই করতাম।

বাংলানিউজ: অলরাউন্ডার হওয়ার ইচ্ছেটা কখন জাগলো?

কাইনাত: ছয় বছর আগে ব্যাটিং শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল কিছুটা শক্তি আমার হাতে আছে। চিন্তা করলাম এটা কেন কাজে লাগাচ্ছি না! এরপরই ব্যাটিংয়ের শুরু।

ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: ক্রিকেট শুরু করতে আপনার মায়ের ভূমিকাটা বলবেন?

কাইনাত: উনি পুরো জীবন স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক ছিলেন। আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। মা ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। আমার মধ্যে উনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। আমি পাকিস্তানের হয়ে খেলে এটা পূরণ করেছি। উনি এরপর ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। অনেকদিন অপেক্ষা করেছেন। এখন মা আন্তর্জাতিক আম্পায়ার, পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমরা পুরো পরিবার উনাকে নিয়ে গর্বিত।

বাংলানিউজ: আপনি যখন প্রথম জাতীয় দলে ডাক পেলেন, উনি কী বলেছিলেন মনে আছে?

কাইনাত: আমি যখন প্রথম ডাক পাই, উনি আমাকে কল দিলেন। খুব রোমাঞ্চ নিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে একটা খবর আছে কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না। ' আমার আগ্রহ বেড়ে গেল, 'জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে?' তখন উনি বলল, 'তুমি পাকিস্তানের হয়ে খেলবে। ' ওই দিনের আনন্দ বলে বোঝাতে পারবো না।

বাংলানিউজ: আপনি পাকিস্তানে দলে যখন ডাক পেলেন, পরীক্ষা ছিল, আপনি তো একটাও দেননি। এই সিদ্ধান্ত নিতে ভাবতে হয়নি?

কাইনাত: একবারও না। এখানে কঠিন কিছু ছিল না, কারণ আমি পাকিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার বাবা-মা সবসময় বলেছে, জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। যদিও আমার একাডেমিক পড়াশোনাও ভালো, আমার কলেজ সমর্থন জুগিয়েছিল। সমস্যা হয়নি। পরের বছরই আমি সবগুলো পরীক্ষা দিয়েছি।

বাংলানিউজ: আপনার মা যখন আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়ালেন, আপনিও তখন একই শহরে। অনুভূতি কেমন ছিল?

কাইনাত: আমার মায়ের সঙ্গে অন্য আম্পায়ারদের তো কোনো পার্থক্য নেই। শুধু এটুকুই যে আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। এর বাইরে, মা তার কাজে খুব ভালো। উনি তার কাজ করছে, আমি আমারটা।

বাংলানিউজ: আপনার মা আম্পায়ারিং শুরু করেছেন ২০০৬ সালে। এখন ২০২২। লম্বা একটা সময়। সময়টুকু কত কঠিন ছিল?

কাইনাত: এটা কঠিন ছিল। কারণ তিনি এটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একসময় ধৈর্য হারিয়ে আম্পয়ারিং ছেড়েও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবা তাকে না করে। আম্পারিংয়ের জন্য অনুপ্রাণিত করে। আসলে আমার বাবার জন্যই আমি ও মা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: এটাই জানতে চাচ্ছিলাম। আপনাদের সাফল্যের পেছনে আপনার বাবার ত্যাগ...

কাইনাত: ত্যাগ? আমার মনে হয় বাবা আসলে আমাদের জন্য পুরো জীবনই দিয়ে দিয়েছে। আমার একটা ভাইও আছে। আমাদের একটা ভালো ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য উনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। আমরা যে এখানে আছি, এটা উনার নিজেরও স্বপ্ন ছিল।

বাংলানিউজ: পাকিস্তানের মতো একটা রক্ষণশীল দেশে মেয়েদের জন্য ক্রিকেট খেলা কেমন কঠিন?

কাইনাত: এটা কঠিন অনেকের জন্য। আপনার বাবা-মায়ের সমর্থন দরকার। আপনি যদি তাদের সঙ্গে কথা বলেন, আমার মনে হয় তারা মেনে নেবে। সমাজ রক্ষণশীল, কিন্তু আপনার বাবা-মায়ের সমর্থন দরকার।

বাংলানিউজ: জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া। এই অনুভূতি আসলে কেমন?

কাইনাত: গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি। দেশের হয়ে খেলাটা সম্মানের। যতবারই জাতীয় সংগীত শুনি, একই রকম অনুভূতি হয়।

বাংলানিউজ: আপনার মা তো স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ক্লাস মিস করতেন ক্রিকেটের জন্য?

কাইনাত: করতাম কলেজে থাকতে। এখন তো করি না...(হাসি)

বাংলানিউজ: ক্রিকেটার হিসেবে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন কোনটা দেখেন?

কাইনাত: পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা।

ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।