ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

সাক্ষাৎকারে মালয়েশিয়া নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক

‘মেয়ে বলে যারা খেলায় নেয়নি, তারা এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০২২
‘মেয়ে বলে যারা খেলায় নেয়নি, তারা এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করে’ উইনিফ্রেড দুরাইসিংগাম/ছবি: শোয়েব মিথুন

পেশায় তিনি স্কুলশিক্ষক। তবে ক্রিকেট তার জীবনজুড়ে।

বাড়ির আঙিনায় শুরু করেছিলেন, মেয়ে বলে তখন নেওয়া হয়নি তাকে। সময় বদলেছে, মালয়েশিয়ার নারী ক্রিকেটের মূলভিত্তি হয়ে গেছেন উইনিফ্রেড দুরাইসিংগাম।

নারী এশিয়া কাপ খেলতে সিলেটে এসেছিলেন তিনি। সেখানেই বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান বাপ্পি শুনেছেন উইনিফ্রেডের জীবনের গল্প, স্বপ্ন আর তার চোখে দেখা সম্ভাবনার কথা।  

বাংলানিউজ: মালয়েশিয়ার মতো দেশে আপনার ক্রিকেটের শুরুটা কীভাবে হলো?

উইনি: আমার শুরু হয়েছিল ছেলেদের সঙ্গে রাস্তায় খেলে। প্রথম দিকে খেলতে যাওয়ার পর তারা বলেছিল, ‘মেয়েদের নেওয়া যাবে না। ’ এমন বলতো কারণ তারা ভয় পাচ্ছিল যে মেয়েরা খেলতে গেলে আঘাত পেতে পারে। তাতে ওরা বিপদে পড়বে।

এরপর একদিন আমার আঙ্কেল আমাকে বলল, ‘ভয় পেয়ো না, তুমি বোলিং করো। ’ তখন আমি বল শুরু করলাম, ওই সময় ব্যাটিং একদমই করতাম না। যদিও ইচ্ছে করতো ব্যাট করার। কারণ ছেলেদের চার-ছক্কা মারতে দেখে লোভ হতো।  

বাংলানিউজ: এরপর জাতীয় দলে কীভাবে এলেন?

উইনি: একদিন নেটে বল করছিলাম ক্লাবের একটা ম্যাচে। তখন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ককে বোল্ড আউট করে দেই। ওই সময় নির্বাচকরাও ছিলেন সেখানে। আমাকে তারা বলল, ‘তুমি জাতীয় দলে যোগ দিচ্ছো না কেন?’ এভাবেই আসলে জাতীয় দলে চলে আসা আর উদ্বোধনী বোলিং করা।

বাংলানিউজ: নেট থেকে একদম জাতীয় দলে?

উইনি: হ্যাঁ, কেবল নেটে দেখেই। আমি এর আগে বড় কোনো ম্যাচ খেলিনি। এক-দুইটা ক্লাব ম্যাচ খেলেছি হয়তো। এরপর থেকে মালয়েশিয়ার হয়ে প্রথম ওভারটা আমিই করতে যাই!

বাংলানিউজ: দেশের জার্সি গায়ে দেওয়ার পর ওই ছেলেদের সঙ্গে কথা হয়েছিল? যারা মেয়ে বলে আপনাকে খেলায় নেয়নি...

উইনি: হা হা হা! এখন দেখা হলে তারা বলে, ‘তোমাকে তখন নেইনি আর সেই তুমি জাতীয় দলে খেলছো!’ আমাকে নিয়ে তারা গর্ব করে। এখন অবশ্য সমর্থনও দেয়।

বাংলানিউজ: বাড়ির আঙিনায় খেলা শুরু, কিন্তু ঠিক কখন থেকে ক্রিকেট নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন?

উইনি: তখন আমার বয়স ১০ বছর। যখন ছেলেদের বাইরে খেলতে দেখতাম, আমিও এমন চাইতাম। আমার ভাই আর চাচাতো ভাইয়েরা জাতীয় দলের হয়ে খেলতো। আমিও তেমন হতে চাইতাম। এখন কিন্তু নিজের ওই লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি...!

বাংলানিউজ: আপনার চাচার সহযোগিতা নিয়ে আরেকটু যদি বলতেন...

উইনি: চাচা মারা গেছেন। কিন্তু উনি এখনও আমাকে ভালো করতে উদ্বুদ্ধ করেন। কারণ তিনি আমাকে শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ায় অনুশীলন করতে পাঠিয়েছেন, ম্যাচ খেলিয়েছেন। আশা করি আকাশ থেকে দেখে উনি আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।

বাংলানিউজ: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে উদ্বোধনী বোলার ছিলেন বললেন, এখন তো উদ্বোধনী ব্যাটিংও করেন...

উইনি: শুরুর দিকে জাতীয় দলে শুধু বল করতাম। তখন আমার বয়স মাত্র ১৪। স্কোয়াডেও আমাকে বোলার হিসেবেই নেওয়া হতো। ছুটিতে একবার অস্ট্রেলিয়া গেলাম, গিয়ে দেখি মেয়েরাও বড় বড় ছক্কা মারছে। একদম ছেলেদের মতো করে। আমার মনে হলো তাদের মতো হতে হবে।

এরপর চাচা আমাকে নেটে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে বল থ্রো করবো। তুমি ব্যাট করো। ’ সেদিন থেকে আমার ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। জাতীয় দলে শুরুতে ১১ নম্বরে নামতাম আমি; এরপর আস্তে আস্তে ৬, ৪, ৩ থেকে এখন ইনিংস উদ্বোধন করি।

বাংলানিউজ: আপনি তো অস্ট্রেলিয়ার একটা ক্লাবের হয়েও খেলেছেন। আপনাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধানটা কত বড়?

উইনি: অস্ট্রেলিয়ায় একটা লিগে খেলতে গিয়েছিলাম সাত-আট বছর আগে। অনেক কিছু শিখেছি। কারণ তাদের সংস্কৃতিটাই আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ ক্রিকেটের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু মালয়েশিয়াতে আমাদের একদম গোড়া থেকে শুরু করতে হয়।

এভাবেই শিখেছি, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। টি-টোয়েন্টি খেলেছি, ওয়ানডেও। আমরা চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম টুর্নামেন্টে। ওখানে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেগুলোকে এখানে নিয়ে এসেছি। মেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছি, তাদের বলেছি কীভাবে কী হয়।

বাংলানিউজ: তখন কোনো তারকার সঙ্গে কথা হয়েছে?

উইনি: ওই সময় আমি শুধু ছেলেদের ক্রিকেট দেখতাম। কারণ টিভিতে মেয়েদের খেলা তখন এত জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু এখন দেখতে পারেন, মেয়েদের ক্রিকেট উঁচু থেকে আরও উঁচুতে যাচ্ছে। আমি তখন কারো সঙ্গে কথা বলিনি।  

২০১৮ সালে এশিয়া কাপে খেলেছিলাম আমরা মালয়েশিয়ায়। তখন থেকে অনেক তারকার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি, শিখেছি। নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি। এ বছর দুবাইয়ের ফেয়ার ব্রেক লিগে খেলে অনেক কিছু শিখলাম। অনেক আন্তর্জাতিক তারকার সঙ্গে খেলেছি এই টুর্নামেন্টে। স্টেফেনি টেইলর, সুফি দেওয়াইন, সুনীলো; তারা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে।

বাংলানিউজ: এই টুর্নামেন্টে কারো সঙ্গে কথা হয়েছে?

উইনি: হ্যাঁ, সেদিন আমাদের ম্যাচের পর ভারতের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর জেমাইমার (ভারতের ক্রিকেটার জেমাইমা রদ্রিগেজ) সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। তারা খুব বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। তারা তাদের অভিজ্ঞতা বলেছে, আমাদের মেয়েদেরও অনেক প্রশ্ন ছিল। আশা করি মেয়েরা এখান থেকে কিছু নিতে পেরেছে। যা কিছুই বলেছে, এটা থেকে নিয়ে তারা উন্নতি করবে।

বাংলানিউজ: মালয়েশিয়ায় প্রথম যে ১৫ জন মেয়ে ক্রিকেটারের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, আপনি তাদের একজন। এটা আপনাদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে কেমন সাহায্য করবে?

উইনি: এই চুক্তিটা পাওয়ার পর মেয়েরা অনেক কিছুতে উন্নতি করেছে। অনুশীলনে আরও বেশি পরিশ্রম করছে, খেলাটা নিয়ে আরও বেশি শিখতে চাইছে। আগের চেয়ে বেশি ম্যাচ দেখছে আর অভিজ্ঞতা অর্জন করছে।  

বাংলানিউজ: জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতি কেমন?

উইনি: আমি অনেক বেশি গর্বিত জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে। আন্তর্জাতিক তারকাদের সঙ্গে খেলতে পারা অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমি নিশ্চিত মেয়েরাও খুব রোমাঞ্চিত ও গর্বিত বুকে জাতীয় পতাকা নিয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে।  

বাংলানিউজ: ১৪ বছরে অভিষেক, ১৭ বছর বয়সে তো অধিনায়কও হয়ে গিয়েছিলেন...

উইনি: হ্যাঁ, অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর শুরুর দিকে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। চিন্তা করছিলাম কীভাবে এই পরিস্থিতি সামলাবো। কিন্তু পরে তো পারলাম, শক্ত হতেও পেরেছি। এখন জানি কীভাবে মেয়েদের সামলাতে হয়, তাদের সবকিছু বুঝতে পারি। এজন্যই এখনও আমি অধিনায়ক। আমার ওপর বিশ্বাস রাখায় মালয়েশিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

বাংলানিউজ: আপনি যখন খেলা শুরু করলেন, মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে ক্রিকেট কেমন ছিল?

উইনি: ওই সময় খুব বেশি ম্যাচ খেলতাম না। ক্রিকেটেও খুব বেশি মেয়ে ছিল না। তখন হয়তো ১৫-১৬ জন মেয়ে খেলতো। কিন্তু এখন আপনি দেখবেন সব পর্যায় থেকে ক্রিকেটার আসছে। স্কুলে ক্রিকেট হচ্ছে, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খেলা হচ্ছে। আমি মালেশিয়ার ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।  

বাংলানিউজ: মালয়েশিয়ার অধিনায়ক হিসেবে কেমন স্বপ্ন দেখেন?

উইনি: দলকে নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে চাই। আর আশা করি আমরা পরের টুর্নামেন্টে আরও ভালো করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২২
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।