চট্টগ্রাম: ভূ-আঞ্চলিক কারণে মাদকের উৎপত্তির নিকটস্থ ত্রিভূজের সীমানায় বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় এখানে মাদক প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে অনায়াসে। তাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিরা তাদের অবৈধ ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছে।
এ অবস্থায় নিত্যনতুন মাদকদ্রব্যে ছেয়ে গেছে চারদিক। মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় থেমে নেই।
মাদক আইনের মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য ডিসি, এসপি, ওসি ও আইওকে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাকেও সাক্ষী আনাসহ মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে মোট মাদকের মামলা ছিল ১০ হাজার ৬২৬টি। ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৮৫টি। ২০২১ সালে বিচারাধীন ছিল ১০ হাজার ৩৪৩টি মামলা। ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৫১টি। ২০২১ সালে মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২৮৩টি। ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬৭টি। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মাদকের মামলা হয়েছিল ২ হাজার ৬৪৪টি। ২০২২ সালে মামলার সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৬৯টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতায় মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, আদালতে সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে আসেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মাদক মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাক্ষী। কিন্তু অনেক সাক্ষীই আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে নারাজ। সমন জারির পরও সাক্ষী হাজির হয় না। অনেক মামলার সাধারণ সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না। মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকে সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়। তাই সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে গেলে সাক্ষী সঠিক সময়ে হাজির হয় না। কেউ বদলি হয়ে গেলে অন্য জেলা থেকে এসে সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ৪৪ ধারায় মাদকের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল স্থাপননের কথা বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংশ্লিষ্ট জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেন বলেও আইনে বলা হয়েছে।
এই আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী, মাদকদ্রব্যসহ আসামি ধরা পড়লে আদালতে সোপর্দ করার ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে এবং আসামি ধরা না পড়লে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা এতে ব্যর্থ হলে কারণ উল্লেখ করে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেবেন। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এবং আদালতে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী প্রতিবেদন দিতে হবে। এরপর যদি নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়, তাকে আসামিসহ মামলা ১৫দিন এবং আসামিহীন মামলা ৩০দিনে তদন্ত শেষ করতে হবে। নতুন আইনের ৫১ ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা পাওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টকে লিখিতভাবে জানাতে হবে এবং এর অনুলিপি সরকারকে পাঠাতে হবে। একইভাবে আরও ১৫দিন সময় বাড়াতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল।
চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, মাদকের মামলার অধিকাংশই সাক্ষীর জন্য নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সাক্ষী হাজিরের জন্য সমন দিলেও আদালতে উপস্থিত হয় না। অথচ আদালতে সাক্ষী এলে ফেরত পাঠানো হয় না। আগের চেয়ে মাদক মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে। বর্তমানে মাদক মামলায় দ্রুত সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে। আগামি ছয় মাসের মধ্যে আরও অনেক মামলা নিষ্পত্তি হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মাদকের পরিমাণ ও মূল্যের দিকেই শুধু গুরুত্ব না দিয়ে ছোট-বড় সব মাদক মামলায় গুরুত্ব দিতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতিতে এসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আদালতে মামলা জট বাড়ছে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকায় অনেক আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে ফের মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর এর সাধারণ সম্পাদক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচার ও প্রচারণা করতে হবে মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারদের মাধ্যমে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকার, সকল রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩
এমআই/টিসি