চট্টগ্রাম: প্রবাদ আছে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। কিন্তু যখন পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থারই স্বাস্থ্য খারাপ থাকে তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় কর্তৃপক্ষের নেওয়া সকল উদ্যোগ।
করোনায় হাসপাতালসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও এখনও উন্নয়ন হয়নি সেবার মানের।
এবছর যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে তেমন বিতর্ক ছড়িয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে। হুইপের টিকাকাণ্ড ও টাকার বিনিময়ে টিকাদান এবছর চট্টগ্রামের আলোচিত ইস্যু হলেও বছরের শেষদিকে চমেকে দুইপক্ষের সংঘর্ষে আহত এক শিক্ষার্থীর মুমূর্ষু অবস্থার ছবি নাড়া দিয়েছে জাতির বিবেককে।
হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন
করোনা যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য। এক সময়ের অবহেলিত হাসপাতালটি এখন নগরবাসীর জন্য ভরসাস্থল। কিছু না থাকা হাসপাতালটিতে এবছর নতুন করে যুক্ত হয়েছে এইচডিইউ। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার জন্য বসানো হয়েছে বিদ্যুৎ সাব স্টেশন, আরও বসানো হচ্ছে অক্সিজেন জেনারেটর। এছাড়াও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর প্রাক্কালে চালু করা হয় নতুন করোনা ওয়ার্ড।
অন্যদিকে এবছর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নতুন করে চালু হয় ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, এই ইউনিটে পাওয়া যাবে একসঙ্গে সব সেবা। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। এই ইউনিটে সেবা পাওয়ার চেয়ে ভোগান্তিই যেন বেশি।
চট্টগ্রামের করোনা চিকিৎসায় আরেক হাসপাতাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)। এবছর উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এ হাসপাতালেও। ঢাল-তলোয়ার ছাড়া অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা এই হাসপাতালে বসানো হয় ৫ শয্যার আইসিইউ। সঙ্গে বসানো হচ্ছে অক্সিজেন প্লান্ট ও বায়োসেফটি ল্যাব। যার সব মিলিয়ে ব্যয় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ।
এছাড়া, বছরজুড়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার ইউনিট ও বার্ণ ইউনিট স্থাপানের গুঞ্জন থাকলেও বছর শেষে কোনও অগ্রগতি ছিল না। তবে বেসরকারি খাতে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।
টিকা কাণ্ড ও টিকা চুরি
চলতি বছরের আগস্ট মাসে শুরু হয় গণটিকাদান কার্যক্রম। কিন্তু সরকারিভাবে টিকাদান কার্যক্রম চালু করার আগে পটিয়ায় হুইপ সামশুল হকের এলাকায় আগেভাগে টিকাদান কার্যক্রম চালানোর ঘটনা দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুইজনকে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হলেও ধরা ছোঁয়ার বাহিরেই রয়ে যায় মূল হোতারা।
অন্যদিকে, জুলাই মাসে চট্টগ্রামের হাজারীগলিতে করোনার টিকা বিক্রি করে লাখ টাকা আয়ের খবর গণমাধ্যমে আসে বেশ ফলাও করে। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী এক কর্মচারীকে দায়ি করা হলে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় চসিক।
টিকাদান কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা
এ বছর টিকাদান কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা যেন সীমা ছাড়িয়েছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জেনারেল হাসপাতালে টিকা নিতে আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।
এতসব ঘটনার মধ্যেও চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টিকাদান কার্যক্রমে গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪ লাখ ৮ হাজার ৬৭৪ জন টিকা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নেওয়া টিকা গ্রহীতার সংখ্যা ৩৮ লাখ ২১ হাজার ৯৭৯ জন এবং উভয় ডোজ টিকা গ্রহীতার সংখ্যা ২৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৫ জন।
চট্টগ্রামেও শনাক্ত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস
করোনা পরবর্তী সময়ে নতুন আতঙ্কের নাম ছিল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। এই রোগে আক্রান্ত রোগীও দেখেছে চট্টগ্রাম। ২৫ জুলাই চট্টগ্রামে প্রথম ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্ত নারী রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় রোগী ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ পাওয়া যায়। এসব রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংঘাতপূর্ণ চমেক
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে দুইপক্ষের সংঘর্ষ বেশ আলোচিত হয়েছে। কথায় কথায় একে অপরের ওপর হামলা, ভাংচুর মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর জেরে একাধিকবার কর্মবিরতিতে যায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। রোগীদের জিম্মি করে এমন কর্মবিরতির সমালোচনা হলেও তা গায়ে মাখেননি তারা।
দীর্ঘদিন ধরে ‘ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)’ সক্রিয় রয়েছে চমেক হাসপাতালে। এটি সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ (ইচিপ) গঠন করে অপর একটি পক্ষ, যারা শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসাবে পরিচিত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল
চলতি বছরের ২৯ অক্টোবরের দু’পক্ষের সংঘর্ষ ছাড়িয়ে যায় অতীতে সব ইতিহাস। এক শিক্ষার্থীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে রীতিমত আইসিইউতে পাঠিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ। গুরুতর আহত মাহাদি জে আকিব নামের ওই শিক্ষার্থীর একটি ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেখানে তার মাথায় লেখা ছিল ‘হাড় নেই চাপ দিবেন না। ’ এছাড়া এবছর ২০ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারগামী রিলাক্স পরিবহনের একটি বাসে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনাও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
চট্টগ্রামে করোনায় মৃত্যু
এবছর করোনা নিয়ে বেশ সতর্ক অবস্থায় ছিল প্রশাসন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকে আইসিইউ, অক্সিজেন নিয়ে তেমন হাহাকার না থাকলেও প্রাণহানি বাড়ে এবছর। এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১ হাজার ৩৩২ জনের মধ্যে শুধু এবছরই করোনায় মারা গেছেন ৯৭৩ জন। এর মধ্যে করোনায় অন্তঃসত্ত্বা এক চিকিৎসকের মৃত্যু কাঁদিয়েছে নগরবাসীকে। তাছাড়া এবছর চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৭২ হাজার ২৬০ জন।
বছরজুড়ে আলোচনায় থাকা স্বাস্থ্যখাত নতুন বছরে নতুন করে পথ চলতে শিখবে বলে বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের। এ খাতের সংশ্লিষ্টদের সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান সেবা প্রত্যাশীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২১
এমআর/এসি/টিসি