ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘প্রতিদিন ধরে নিই, এটাই আমার শেষ দিন’

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০২২
‘প্রতিদিন ধরে নিই, এটাই আমার শেষ দিন’ ...

চট্টগ্রাম: প্রথাবিরোধী লেখক আখতারুজ্জামান আজাদ। শৈশব-কৈশোর কেটেছে বরগুনা জেলায়।

বরগুনা জিলা স্কুলে মাধ্যমিক, নটরডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে।

চট্টগ্রাম বইমেলায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

বললেন নিজের কথা, জানালেন অপ্রিয় কিছু সত্য।

ঢাকার বইমেলা ও চট্টগ্রামের বইমেলার মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আখতারুজ্জামান আজাদ বলেন, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য খুঁজে পাই না। একই রকমের আগ্রহ সবার মধ্যে, জনসমাগমও প্রায় একই। তবে ঢাকা বইমেলা ৩৮-৪০ বছরের পুরোনো বলে হয়তো কলেবরটা বড়। ওখানে প্রচারও বেশি।  

আখতারুজ্জামান আজাদের মতে, দেশের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সব অফিস-শিল্পকারখানার সদর দফতর ঢাকায়। এটার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। এখন বিভিন্ন জেলায় জেলায় বইমেলা হচ্ছে। এতে ঢাকার ওপর একটু হলেও চাপ কমছে। আমাদের মনমানসিকতা যে ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, তা থেকে বের হয়ে এসে বিভাগে বিভাগে বা বড় জেলায় বইমেলা আয়োজন করতে পারছি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারছি, এটা জরুরি ছিল। মৌমাছি ও মধু যেমন এক থেকে আলাদা হয়, তেমনি সবকিছুর বিকেন্দ্রীকরণ দরকার।  

লেখালেখির মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, নিজের লেখা নিয়ে যে লেখক সন্তুষ্ট সে কখনোই ভালো লেখক হতে পারে না। আসলে নিজের লেখার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট থাকতে হয়। জোরপূর্বক যে থাকতে হয় তা নয়। আমি আমার নিজের লেখার ব্যাপারে একটুও সন্তুষ্ট নই। আজ যা লিখি এর ৪-৫ দিন পরে মনে হয় এর চেয়ে বড় কোনও আবর্জনা আর কোনোকিছু হতে পারে না এবং এই আবর্জনা না হলে মানবজাতির খুব একটা বেশি ক্ষতি হতো না।  

‘আজ থেকে ১০ বছর আগে যেই বইগুলো লিখেছি সেগুলোকে দেখলে মনে হয় যে, এইসব বইয়ের জন্য লেখক আমাকে সম্মান করছে, টাকা খরচ করে বই নিচ্ছে। এটা দেখে আমার খুব লজ্জা হয়৷ সবসময় আমি চেষ্টা করি, গত ১০ বছরের লেখার চেয়ে এই বছরের লেখাটি যেন আরও ভালো হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, এই বছরের লেখাটি আগামি ২০ বছর পরে ফাজলামো বলে মনে হবে। আমি আমার নিজের লেখার ব্যাপারে কখনোই সন্তুষ্ট ছিলাম না। আর সন্তুষ্ট যে লেখক থাকে, সে সামনে এগুতেও পারে না৷ আত্ম-অসন্তুষ্টি হচ্ছে একজন লেখকের সবচেয়ে বড় প্রেরণা’।  

আখতারুজ্জামান আজাদের লেখালেখি শুরু হয়েছিল ২১ বছর আগে একটি মাসিক পত্রিকায় ছড়া ছাপানোর মধ্য দিয়ে। তাঁর কথায়, ‘টের পেলাম যে আমিও পারি, আমাকে দিয়ে হবে। ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় যখন এলাম, বিদ্রুপ সাময়িকীগুলোতে রাজনৈতিক বিদ্রুপ নিয়ে লেখা শুরু করলাম। এ পর্যন্ত যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ‘গণকবিতাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ আমার শ্রেষ্ঠ বই’।  

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার লেখার একটাই নীতি। আমি তখনই লিখি যখন আর না লিখে পারি না। আজ থেকে যতদিন আমি বাঁচবো তখন যদি মনে হয় যে আমার আর লেখার দরকার নেই, আমি আর একটা লেখাও লিখবো না। আর আমার যদি আগামি এক বছর পরে মনে হয় যে, ছড়া লেখা দরকার আমি এর জন্য ১ বছর অপেক্ষা করবো। মেলা চলে এসেছে, বাজার ধরতে হবে, এজন্য আমার নতুন লেখা লিখতে হবে- এই চিন্তায় আমি আগ্রহী নই। এমনকি একটি গল্প লেখার জন্য আগামি ২৬ বছরও যদি অপেক্ষা করতে হয়, আর আমি যদি বাঁচি ওই ২৬ বছর পরেই লিখবো। মাঝখানে বাজার ধরার জন্য আমি কোনোকিছু করবো না’।  

অনেকে তারকা সাজার জন্য বাইরে থেকে লোকজন নিয়ে এসে মেলার মধ্যে কৃত্রিম ভিড় সৃষ্টি করেন- এমন বক্তব্যের জবাবে আখতারুজ্জান আজাদ বললেন, ‘যারা সংক্ষেপে তারকা হয় তারা আবার সংক্ষেপে ঝরেও যায়৷ যতক্ষণ মিছিল ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তারকা এবং সে নিজের কাজে নিজে সন্তুষ্ট বলে মনে হয় না। এরা দিন শেষে বাসায় গিয়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায় তখন নিজেকে ভণ্ড-বাটপার মনে হয়। বিবেকের কাঠগড়ায় যখন সে দাঁড়ায় তখন খুবই লজ্জিত হয়। লজ্জিত জীবন একজন লেখক যাপন করতে পারে না’।  

ফেসবুকে সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে বিদ্রুপাত্মক লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় আমি ২৪ ঘন্টা পাই। বিভিন্ন সময়ে আমার বিরুদ্ধে মামলার জন্য বিভিন্ন তরফ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, মামলা করার মতো ঘটনা এটা না। প্রথাবিরোধী লেখক যারা, তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন। এখন আমি অনিরাপদ এটা ভেবে ভেবেই যদি সারাদিন ঘরে বসে থাকি তাহলে ওই তেলাপোকার জীবনই যাপন করতে হবে। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হবার সময় ধরে নিই যে, এটাই আমার শেষ দিন’।  

পাঠকের প্রতি আখতারুজ্জামান আজাদের পরামর্শ, সৎ লেখকদের বই পড়বেন। একটা বই পড়ে যদি মনে হয় যে তিনি সৎ, তিনি পরিশ্রম দিয়েই তাঁর বইটা লিখেছেন, তখন তাঁর বইটা পড়বেন। আর যদি মনে হয় তিনি অসৎ, তখন পরবর্তী বইটি কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে, টাকার অপচয় করা যাবে না।

আখতারুজ্জামান আজাদের প্রকাশিত বই: শুদ্ধ হব- হবে? (২০১০), পর্দা ছেঁড়ার স্পর্ধা (২০১১), শূদ্র মুখে রুদ্ৰ বচন (২০১২), বিষময় বিস্ময় (২০১৩), ইয়াম্মি সিরিজ (২০১৪), জনতার মাঝে নির্জনতা (২০১৫), সামরিক কবি বেসামরিক প্রেমিক (২০১২), প্রিয়াঙ্গনে রণাঙ্গনে (২০১৪), ইয়াম্মি সিরিজ রিটার্নস (২০১৬), উসকানিমূলক গল্প (২০১৮), আপনি তখন কোথায় ছিলেন (২০১৮), এই যে আমায় আগুন দ্যাখো (২০১৯), এখন আপনি চুপ কেন (২০২০), বড়দের ছোটগল্প (২০২০), ভয়ের দেশে লয়ের দেশে (২০২১), লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া (২০১৭), গণকবিতাতন্ত্রী বাংলাদেশ (২০১৭) ও আওয়াজ এবার তোলো (২০২২)।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২২
এমআই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।