ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আন্দোলনের মুখে দাবি আদায়ের আরেক নজির 

মোহাম্মদ আজহার, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২২
আন্দোলনের মুখে দাবি আদায়ের আরেক নজির  ...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় হঠাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাস। একে একে চার দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলন চালিয়ে যান চবির ছাত্রীরা।

কর্তৃপক্ষকে সময় বেঁধে দেওয়া হয় মাত্র চার কার্যদিবস।  

গত ২০ জুলাই রাত ১০টায় শুরু হওয়া এ আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়।

একপর্যায়ে রাত ১২টার পর ঘটনাস্থলে আসেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। মৌখিক আশ্বাসের পরিবর্তে চার দফা দাবি পূরণে লিখিত আশ্বাস চান শিক্ষার্থীরা। শেষপর্যন্ত লিখিত আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত করে কর্তৃপক্ষ। ৪ কার্যদিবসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ না হলে প্রক্টরিয়াল বডিকে নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান।  

লিখিত আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা সেই রাতে হলে ফিরলেও পরদিন ২১ জুলাই ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন হয়ে উঠলো আরও জোরদার। শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় মানববন্ধন, মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন সেদিন। আগের মত এবার আর তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায় মেটানোর সুযোগ নেই- সেই হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে।  

একইদিন চবি শিক্ষক সমিতি পূর্বঘোষিত বর্ষাবরণ ও ফল উৎসবের আয়োজন করে পড়েন তোপের মুখে। পরদিন শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিবৃতি দেওয়া হয়। ছাত্র সংগঠনগুলো মিছিল, মানববন্ধন ও বিবৃতির মাধ্যমে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। আন্দোলনের মুখে শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেওয়া চার কার্যদিবসের আগেই দাবি বাস্তবায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।  

সোমবার (২৫ জুলাই) দুপুরে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো আমলে নিয়ে কর্তৃপক্ষের তড়িৎ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবি 

ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা চাই। মেয়েদের হল থেকে বের হওয়া বা প্রবেশে এবং মেডিক্যালে নারী শিক্ষার্থীদের যাওয়ার সময়সীমা তুলে নিয়ে নির্দেশনা দিতে হবে।  
বিশ্ববিদ্যালয়ের অকার্যকর যৌন নিপীড়ন সেল ভেঙে নতুন কার্যকরী যৌন নিপীড়ন সেল গঠন করতে হবে। বিচারের ব্যবস্থা করার সময়সীমা থাকবে ১ মাস এবং তা করতে ব্যর্থ হলে সেল স্বয়ং নিজের শাস্তির বিধান করবে।  যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান কেসগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে চার কর্মদিবসের মধ্যে।  
চার কর্মদিবসের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।

কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ

শিক্ষার্থীদের ১ নম্বর দাবির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিলেও ছাত্রীদের রাত ১০টার মধ্যে হলে প্রবেশের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে- এমন একটি সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ে। চবি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও এ সিদ্ধান্ত ২০ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা রটে যায়। এরপর ২০ জুলাই রাত ১০টায় ছাত্রীরা বিক্ষোভ করে। অথচ চবি প্রশাসন এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আদৌ নেয়নি বা দাফতরিক কোনো নির্দেশ দেয়নি।

শিক্ষার্থীদের ২ নম্বর দাবির প্রেক্ষিতে যৌন নিপীড়ন সেল সক্রিয় করার জন্য চবি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র ইতোমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ৩ নম্বর দাবির প্রেক্ষিতে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের কাছে বিবেচনাধীন অনিষ্পন্ন ৩টি অভিযোগ গত ২১ ও ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ৪ নম্বর দাবির প্রেক্ষিতে চবি প্রশাসন জানিয়েছে, যে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনা ঘটে তারপর চবি প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে সব হলের প্রভোস্ট, রেজিস্ট্রার, ছাত্রছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা পরিচালক এবং প্রক্টরিয়াল বডিকে নিয়ে জরুরি সভা করে। এ ব্যাপারে প্রশাসন দ্রুত প্রতিবেদন দেওয়ার শর্ত সাপেক্ষে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।  

ছয় শিক্ষার্থী বহিষ্কার

আজীবন বহিষ্কার করা হয় চবির ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আজিম এবং নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল আবছার বাবুকে। মো. আজিম ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপ সিএফসি এবং নুরুল আবছার বাবু ভিএক্স’র অনুসারী।  

এ ছাড়া এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের জান্নাতুল ইসলাম রুবেল, দর্শন বিভগের মো. ইমন আহম্মেদ, রাকিব হাসান রাজু এবং আরবি বিভাগের জুনায়েদ আহমেদ। চারজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক উপগ্রুপ সিএফসির অনুসারী।

তদন্ত কমিটির বক্তব্য

ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছিল ৪ কার্যদিবসের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আইনের আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটি ভুক্তভোগী এবং তার সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে ২ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। চবি প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে তদন্ত কমিটি গঠনের ১ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠিত ডিসিপ্লিনারি কমিটি কর্তৃক এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত চবির ২ শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া বহিরাগত অন্য প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে ২০২১ সালে দুই ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনায় চবি চার শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এটিএম রফিকুল হকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের কারণে লিখিতভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া বেগম খালেদা জিয়া হলের এক ছাত্রী হেনস্তার অভিযোগে রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রকে লিখিতভাবে সতর্কের পাশাপাশি সাত কার্যদিবসের মধ্যে মুচলেকা দিতে বলা হয়েছে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নতির লক্ষ্যে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা ও স্থাপনায় পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তা প্রহরীর ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ছাত্রী হেনস্তার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সর্বোচ্চ তৎপরতার মধ্যে দিয়ে এ ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে চবি প্রশাসন নজির স্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সজাগ থাকবে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২২
এমএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।