ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

নেতাজির অপ্রকাশিত ফাইল আদৌ প্রকাশ পাবে?

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০২১
নেতাজির অপ্রকাশিত ফাইল আদৌ প্রকাশ পাবে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

কলকাতা: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ভারতে উৎসাহ তুঙ্গে। ভারত সরকার ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে দিনটিকে ঘোষণা করেছে।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিনটিকে ‘দেশনায়ক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি কোণে এবং ভারতের সব রাজ্যেই দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতাজির জন্মক্ষণ বেলা ১২টা ১০ মিনিটে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে থাকা নেতাজির ভক্তদের শাঁখ, ঘণ্টা ও আজানের পবিত্র ধ্বনি উচ্চারণের অনুরোধ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী আবহেও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে নেতাজিকে স্মরণ করার বিষয়টি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইলের প্রকাশ হবে কিনা তা নিয়ে। তাদের প্রশ্ন সেই ফাইল কি আদৌ প্রকাশিত হবে, যার মাধ্যমে জানা যাবে সমস্ত সত্য।

১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনার যে তত্ত্ব বা রেনকোজি মন্দিরে যে ভস্ম রাখা আছে তার সত্যতা সম্পর্কেও তথ্য জানতে চায় ভারতের প্রত্যেকটি মানুষ।

কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সাধারণ মানুষ নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে কোনো তথ্যই জানতে পারেনি। যদিও সরকারি তরফে বেশ কিছু ফাইল প্রকাশ করা হয়েছে, তবুও সম্পূর্ণ সত্য আজও অধরা।

ভারতে নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে তৈরি হওয়া বিচারপতি মুখোপাধ্যায় তদন্ত কমিশন ২০০৫ সালে জানিয়ে দেয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুর প্লেন দুর্ঘটনার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে সত্য কী? এই প্রশ্ন প্রতিবার জেগে ওঠে সুভাষচন্দ্র বোসুর জন্মদিনে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারে কাছে থাকা নেতাজি সম্পর্কিত ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৪-এর ফাইলগুলিতে দেখা যায় নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে ১০টি তদন্ত হয়েছিল। সবকটি তদন্তই দাবি করে, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকু প্লেন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।

কিন্তু এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন একাধিক নেতাজি গবেষক। বিচারপতি মুখোপাধ্যায় তদন্ত কমিশন ২০০৫ সালে জানিয়ে দেয়, ১৯৮৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুর প্লেন দুর্ঘটনার কোনো প্রমাণ মেলেনি।

এমনকি ২০০৩ সালের মার্চে তাইপের মেয়র এক ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তাইপে সিটি আর্কাইভে সেই দিন তাইপেতে কোনো প্লেন দুর্ঘটনার উল্লেখ নেই।

মৃত্যুর প্রমাণডেথ সার্টিফিকেট। বাস্তব সত্য এই যে, নেতাজির ডেথ সার্টিফিকেট কখনও উদ্ধার হয়নি। তাইহোকু পৌরসভার ক্রিমেশন রেজিস্ট্রারের রেকর্ড বলছে, ১৯৮৫ সালের ১৯-২১ আগস্টের মধ্যে ৪ জন পুরুষের শেষকৃত্য হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে নেতাজি যে ছিলেন তার কোনো প্রমাণ নেই।

সম্প্রতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্যের রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তারা দাবি করেছে ভারত সরকারের হাতে থাকা সমস্ত ফাইল প্রকাশ করা হোক।

ইতিহাসের পাতায় নেতাজির অন্তর্ধানের ঘটনাটি ‘গ্রেট এসকেপ’ বলে পরিচিত। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ব্রিটিশের চোখকে ধুলো দিয়ে জার্মানি পাড়ি দেন নেতাজি। কিন্তু স্বাধীন ভারতে কি পা রেখেছিলেন এই মহান দেশপ্রেমিক?

এই নিয়ে অনেক জল্পনা আছে। তার মধ্যে একটি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর একটি ঘটনা। জনৈক ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের তৈরি ফরেনসিক ফেস-ম্যাপিং রিপোর্ট বলে, ১৯৬৬ পর্যন্ত নেতাজি বেঁচে ছিলেন। ওই বিশেষজ্ঞের মত অনুযায়ী তাসখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর একটি ছবিতে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজনের মধ্যে একজনের মুখের সঙ্গে নেতাজির মুখের অস্বাভাবিক সাদৃশ্য রয়েছে। তাসখন্দ আলোচনার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী তাঁর পরিবারকে ফোন করে বলেন, তার সঙ্গে এমন একজনের দেখা হয়েছে যিনি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কে ছিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি? সেটা জানা যায়নি। এই নিয়ে জল্পনা আজও বর্তমান।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নেতাজির ফাইলগুলি প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা ৬৪টি ফাইল ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে প্রকাশ করা হয়। কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালায় রাখা হয় ফাইলগুলিকে। এছাড়া ১০০টি ফাইল প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অনেকেই মনে করেছিলেন এর ফলে হয়তো নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে যে ধোঁয়াশা আছে সেটা কাটবে।

ফাইল প্রকাশ নিয়ে ভারতের মানুষের মনে সেই সময় যথেষ্ট উৎসাহ ও উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ফাইল প্রকাশের ফলে বেশ কিছু তথ্য হাতে এলেও আসল তথ্য, মানুষ যেটা জানতে চায় সেটা সামনে আসেনি।

বিভিন্ন সময় ভারতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন জায়গায় ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতাজির অন্তর্ধানের সব সত্য সামনে এলে বৈদেশিক রাজনীতিতে ভারতের সমস্যা বাড়বে। কিন্তু অন্তর্ধানের এত বছর বাদে কোন ‘সত্য’ প্রকাশ করলে বাস্তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কতোটা প্রভাব পড়বে সেই নিয়ে ভারতের জনগণের মনে প্রশ্ন আছে।

একই সঙ্গে উঠে আসছে অধিকারের কথা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়কের অন্তর্ধানের কারণ জানার অধিকার প্রতিটি ভারতীয়ের আছে। সেই অধিকার থেকেই ভারতের জনগণ সত্যিটা জানতে চায়।

অনেকের মতে শুধু আন্তর্জাতিক নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে গোপন ফাইলগুলি প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু সত্য যেটাই হোক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্য থেকে পর্দা উঠুক সেটা চায় সমস্ত ভারতীয়। কিন্তু সেটা কবে সম্ভব বা আদৌ কোনোদিন এটা সম্ভব কিনা সেটা জনগণের আজও অজানা এবং হয়তো অজানা থাকবে আরও কিছু বছর।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২১
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।