আগরতলা, (ত্রিপুরা): দুই বছর আগে সন্তানদের দুইবেলা খাবার তুলে দিতে পারতেন না বলে অনাথ আশ্রমে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন যে গৃহবধূ। এখন তিনি নিজে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার রুপি রোজগার করছেন।
আগরতলার পার্শ্ববর্তী রাণীখামার এলাকার গৃহবধূ মন্টি দেবনাথ এই সাফল্য দেখিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে রাণীখামার এলাকার ঝরঝরিয়া গ্রাম। এই গ্রামের অন্য ১০ জন গৃহবধূর মতো এক অতি সাধারণ গৃহবধূ মন্টি দেবনাথ। স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে অভাবের সংসার তার। মন্টি বাংলানিউজকে জানান, তার স্বামীর কোনো রোজগারের ব্যবস্থা না থাকায় পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য মন্টিরও চিন্তার অন্ত ছিল না। পরিবারের হাল ধরার জন্য মন্টি প্রতিদিন রাবার বাগানের গাছ কাটা ও তা থেকে লেটেক্স সংগ্রহ করার কাজ করতেন। এই কাজে মজুরি তুলনামূলকভাবে সারা মাস কাজ করে ৬ থেকে ৭ হাজার রুপি পেতেন মন্টি। তাও আবার বছরের ১০ মাস কাজ করার নিশ্চয়তা থাকে। শুষ্ক মৌসুমে যখন রাবার গাছের পাতা ঝরে যায়। তখন বাগানে কাজ বন্ধ থাকে। তার রোজগারও বন্ধ থাকে। ফলে তখন অন্য কাজের সন্ধানে বেরুতে হয় মন্টিকে। এসব কারণে মন্টির ঘরে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। অভাবের তাড়নায় নিজের সন্তানদের অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। এই আর্থিক কঠিন অবস্থার মাঝেই ২০২০ সালের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে মাশরুম চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন ও তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সেখানে তারা মোট ৬০ জন প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে নিজের হাতে বাড়িতে মাশরুম চাষ করেন। কিছু দিন পর নতুন মাশরুম গজিয়ে উঠে। কিন্তু এরপরও চিন্তার শেষ নেই, এগুলো বিক্রি করবেন কোথায়, এই ভেবে। পরে নিজেই এগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আশেপাশের এলাকায়। এভাবে ঘুরে ঘুরে তিন দিনে প্রায় ৩৫শ টাকার মাশরুম বিক্রি করেন। এরপরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি আর রাবার বাগানে কাজ করবেন না। আরও বড় আকারে মাশরুম চাষ করবেন। এরপর মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে ঘর বানিয়ে এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে মাশরুমের চাষ শুরু করেন তিনি। এখন তার ঘরে প্রায় দুই হাজার প্যাকেট রয়েছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৭ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১২ কেজি পর্যন্ত মাশরুম সংগৃহ হয়। তার এখানে মূলত দুই ধরনের মাশরুম চাষ হয়। এগুলো হলো, ওয়েস্টার এবং মিল্কি মাশরুম। ওয়েস্টার প্রতিকেজি ২০০ রুপি ও মিল্কি মাশরুম প্রতিকেজি ৪শ রুপিতে বিক্রি করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, বাজারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করায় মানুষের মধ্যে তার মাশরুমের চাহিদা অনেক বেশি রয়েছে। মূলত বিভিন্ন অফিস ও বাড়িঘরে ঘুরে ঘুরে মাশরুম বিক্রি করেন তিনি। তাই বিক্রি নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। প্রতিদিন যে পরিমাণ উৎপাদিত হয় তার সবটাই বিক্রি হয়ে যায়। সবমিলিয়ে মাসে এখন ৩০ থেকে ৪০ হাজার রুপির মাশরুম বিক্রি করছেন ওই নারী।
ইতোমধ্যে তিনি মাইক্রো ফিনান্স থেকে নেওয়া ঋণের বেশিরভাগ অংশ মিটিয়ে নিয়েছেন এবং ছেলেমেয়েদের অনাথ আশ্রম থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন। এখন মাশরুম চাষের জন্য প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ খড় কাটতে হয়। তাই খড় কাটার যন্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনেছেন। আগামীতে তিনি মাশরুম চাষের পরিমাণ আরও বাড়াতে চান। এই লক্ষ্যে নিয়ে এগিয়ে চলছেন বলেও জানান তিনি। মাশরুম চাষ বাড়ালে তিনি নিজে অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, একাধিক মানুষের প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে তিনি মাস্টার ট্রেনার হিসেবে অন্যদের মাশরুম চাষের কলা কৌশল শেখাচ্ছেন। ঐশী বাণী সোসাইটির পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য মাশরুম চাষের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে মাস্টার ট্রেনার হিসেবে কাজ করছেন মন্টি দেবনাথ। তার মতো রাজ্যের অন্যান্য নারীরাও মাশরুম চাষের মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন বলেও জানান মন্টি দেবনাথ।
তার এই সাফল্যের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একাধিক সম্মান জানানো হয়েছে তাকে। পাশাপাশি এখন তার স্বামী গণেশ দেবনাথও আগরতলা পৌরনিগমে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ পেয়েছেন। নিজের কাজের পাশাপাশি তার স্ত্রীর এই মাশরুম চাষের কাজে তিনি সহায়তা করছেন।
তিনি নিজে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাশরুম বিক্রি করে থাকেন বলে বাংলানিউজকে জানান গণেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০২২
এসসিএন/এএটি