ঢাকা: কৃষি ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ বিতরণ করে বেসরকারি দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলো। টাকার অংকে এ ঋণ ১৮ হাজার ৩৮২ কেটি টাকা।
চলতি ২০২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করবে ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। বেসরকারি দেশি-নিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করবে ১৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ নীতিমালায় বলা হয়, যেসব ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার (এনজিও) নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) মাধ্যমে বিতরণ করবে। কৃষক পর্যায়ে সুদের হার হবে এমআরএ নির্ধারিত সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ। আর এনজিওগুলো সর্বনিম্ন ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে বাণিজ্যক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেবে।
খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাংকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও বাধ্যতামূলক করতে ২০১০ সাল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের কমপক্ষে ২ শতাংশ বিতরণে বাধ্যতামূলক করে। যে ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে শাখা নেই, কৃষকের দৌড়গড়ায় ঋণ পৌঁছাতে পারবে না, ততদিন বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণে ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। বিশেষ ব্যবস্থাটি হলো এনজিও লিংকেজ ব্যবহার। সে সময় পল্লী ঋণ নীতিমালা তৈরি করা হয় প্রত্যন্ত অঞ্চল যেসব ব্যাংকের শাখা নেই, সেসব অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণে সুবিধা রেখে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে ভূমিকা রাখতে পারছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। সব ব্যাংক কৃষি ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে কৃষিতে ভূমিকা রাখবে সেটাই মূল কথা। যেসব ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে শাখা আছে, তারা নিজস্ব শাখার মাধ্যমে বিতরণ করবে। পল্লী অঞ্চলে শাখা না থাকা ব্যাংক এনজিও লিংক ব্যবহার করে ঋণ বিতরণ করবে। এক সময় এসব ব্যাংক ঋণ বিতরণ করতে পারতো না। এখন কৃষি ঋণ বিতরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। দুটি ভাবনা থেকে তারা কৃষি ঋণ বিতরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
প্রথমত: কৃষিও এখন বড় হচ্ছে, এখন আর সেই কৃষি নেই। এখন খামার, কৃষি প্রক্রিয়াকরণের মতো মাঝারি থেকে বড় কার্যক্রম চলে আসছে।
দ্বিতীয়ত: খাদ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণের জায়গা থেকেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বিদেশি ব্যাংক আল ফালাহ বিতরণ করবে ২৪ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক-এনএ ২৩ কোটি টাকা, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ৯৩ কোটি টাকা, হাবিব ব্যাংক ৭ কোটি টাকা, এইচএসবিসি ব্যাংক অব বাংলাদেশ ১৯৭ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৪০২ কোটি টাকা, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ১৪ কোটি টাকা ও উরি ব্যাংক বিতরণ করবে ১১ কোটি টাকা। এসব ব্যাংক বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এনজিওয়ের সঙ্গে চুক্তি করে টাকাটা দিয়ে দেয়। এরপর এনজিওগুলো তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিতরণ করে। আবার যথা সময়ে এ ঋণ আদায় করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ফিরিয়েও দেয়।
এনজিওয়ের মাধ্যমে কেন কৃষি ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, আবার কেনই বা বাড়তি সুদ নেওয়া হচ্ছে। এনজিও লিংকেজ ব্যবহার করে কৃষি ঋণ বিতরণে এ ধরনের প্রশ্নও আছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে কৃষি ঋণ বিতরণে এত সুদ কেন? কৃষি ঋণে এ বাড়তি সুদ নিয়ে প্রশ্ন অর্থসচিব শেখ সলীম উল্লাহরও।
অন্যদিকে বাড়তি সুদ হলেও এনজিওয়ের মাধ্যমে বিতরণের পক্ষে যুক্তি হলো- এসব ব্যাংকের শাখা কম ও যেগুলো আছে সেগুলো শহরে অবস্থিত। গ্রামে কোনো শাখা নেই। আর কৃষি ঋণও ছোট। ছোট ঋণ বিতরণে অপারেটিং চার্জ পড়ে বেশি। কৃষি ঋণ বিতরণে বেশি খরচ হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখায় না। এ কারণে এনজিও সংযোগের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা হলো একেবারে না বিতরণ করার চেয়ে এনজিও সংযোগ ব্যবহার করে ঋণ বিতরণ ভালো।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ হলো একমাত্র দেশ, যে দেশ ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে শুধু বাংলাদেশই নয়, দেশের বাইরেও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে সুনাম অর্জন করেছে। রয়েছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এজন্য পল্লী অঞ্চলে শাখা না থাকা ব্যাংক এসব এনজিও সংযোগ ব্যবহার করে কৃষি ঋণ বিতরণ করছে।
তৃতীয়ত: বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে কৃষি ঋণ নেওয়া কৃষকের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিতে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের টাকা দিতে হয় ও দীর্ঘ সময় ঘুরতে গিয়ে তার ক্ষতি হয়ে যায়। এরপর ঋণ পেলেও সুদের হার হয়ে যায় বাড়তি সুদের চেয়েও বেশি। কম সুদের ঋণ নিয়ে বেশি টাকা চলে যায় পকেট থেকে। এর চেয়ে এনজিও সংযোগে ঋণ নিলেই বেশি সুবিধা হয়।
চতুর্থত: এনজি বিতরণ করে ছোট ছোট ঋণ। ছোট ঋণ মূলত প্রান্তিক কৃষক, কৃষিজীবী ও ছদ্মবেকার কৃষক ও পল্লী অঞ্চলের ছোট ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকে। কৃষি নীতিমালা কৃষি ঋণের পরিধিও নির্দেশ করে দিয়েছে। এনজিও সংযোগ ব্যবহার করে কৃষি ঋণ বিতরণ করলে প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যাংকের টাকা পৌঁছে যায়।
ঋণ বিতরণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কৃষি ঋণ বিতরণ। আগামীতে এসব বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে কৃষি ঋণের অংশও।
আতিউর রহমান বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি খাদ্য উৎপাদনের বিনিয়োগের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টি করতে না পারলে অন্য বিনিয়োগও ঝুঁকিতে পড়বে। নিজস্ব চ্যানেলে কৃষি ঋণ বিতরণ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। নিজস্ব চ্যানেল প্রস্তুত হওয়ার আগেই এনজিও চ্যানেল বন্ধ করলে কৃষকের কাছে অর্থ যাওয়ার যে ধারাটি তৈরি হয়েছে, তা ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০২৩
জেডএ/আরবি