ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি হলেও হতাশায় কারিগররা

সাজিদুর রহমান রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২৪
বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি হলেও হতাশায় কারিগররা

মানিকগঞ্জ: বংশ পরম্পরায় প্রায় দুই শতাধিক বছর ধরে বাঁশ, বেত শিল্পটিকে লালন করলেও ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি জেলার ঘিওর উপজেলার কুটির শিল্পীদের। বিশ্বের ১০টি দেশে বেতের তৈরি আধুনিক ও সুদৃশ্য সামগ্রী রপ্তানি হলেও মেলেনি প্রাপ্য মজুরি।

এ নিয়ে হতাশতায় দিন পর করছে কারিগররা।

ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জেলার ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের বাঁশ-বেতের এই শিল্পটি। এ কাজে এখনও প্রায় ছয় শতাধিকের ওপরে নারী-পুরুষ কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। স্থানীয় বাজারে এই শিল্পটির কদর না থাকলেও বিদেশে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু রপ্তানির সঠিক পদ্ধতি না জানায় এখনও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এই শিল্পটির কারিগররা। বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের কোম্পানির নামে আর পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে মূল শিল্পীর কষ্টার্জিত গল্পটি।

সরেজমিনে উপজেলার বড়টিয়া ইউনিয়নের শ্রীবাড়ি ঋষিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই রাত অবধি গ্রামের নারী-পুরুষেরা মিলে বাড়ি-ঘরে নানান ধরনের বাঁশ-বেতের সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ বেতের বেনী তৈরিতে আবার অন্যরা শোপিস তৈরিতে কাজ করছেন। এই অঞ্চল গুলোতে সব চেয়ে বেশি তৈরি হয়ে থাকে বেতের ঝুঁড়ি, ফুড বাস্কেট, পেপার বাস্কেট, ওভাল ট্রে, রাউন্ড ট্রে, স্কয়ার ট্রে, আয়নার ফ্রেম, লন্ড্রি বাস্কেট, লেমজার বাতি, সিলিন্ডার, ফুটকাপসহ অন্যান্য শোপিস।  

জেলা প্রশাসন থেকে এই শিল্পটিকে বাঁচাতে ১৫০ সদস্যের সমবায় সমিতি ও তৈরি কুটির সামগ্রীকে অনলাইন ভিত্তিক বিশ্ব বাজার তুলে ধরতে ব্যবস্থা করেও দিয়েছেন। অপর দিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অফিস নির্মাণ ও  আধুনিক সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অনেকেই ব্যবসায় প্রসার করার চেষ্টা করছেন তবে এখনও অনেকেই এই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলাতে পারছেন না।  

অপরদিকে আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, ফ্রান্স, চীন, ভিয়েতনাম, ইংল্যান্ড, সৌদি আরবসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে বিডি ক্রিয়েশন, নেচার ক্রাফট, আড়ং, হিট বাংলাদেশ, তরঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য ক্রয় করে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। সরাসরি বিদেশে রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারায় অনেকেই আবার এই ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের ইতি টানছেন এবং ভিন্ন পেশায় মনোনিবেশ করছেন এই শিল্পীরা।

প্রায় ৪৭ বছর যাবত লক্ষণ সরকার এই বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তার বাবার হাত ধরেই এ পেশায় আসা তার। কারিগর লক্ষণ সরকার বলেন, শিল্পটি একটি সময় অবহেলিত ছিল তবে এখন পূর্বের চেয়ে অনেকাংশেই ভালো। বেত একটি সময় গ্রামের প্রতিটি অঞ্চলেই ছিল তবে এখন প্রায় বিলুপ্ত।  

তিনি আরও বলেন। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ বেত আনতে হয় রাজবাড়ীর পাংশা এলাকা থেকে। এই কাঁচামাল (বেত) কিনে আনার পর তা রোদে শুকিয়ে পাকাতে হয়। বেত কাজের জন্য প্রস্তুত হলে আমরা এই (বেত) দিয়ে স্কয়ার বাস্কেট, লন্ড্রি বাস্কেট, ফুড বাস্কেটসহ আরও অনেক সামগ্রী তৈরি করি। পরে ঢাকা অফিসে পাঠাই এবং সেগুলো বিদেশি বায়ারদের দেখায়। তাদের যদি পছন্দ হয় তবে সেই অনুযায়ী অর্ডার পাই আমরা। ঢাকা অফিসের অর্ডার অনুযায়ী আমরা যে কাজ করি। তবে সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক আমরা কেউ পাই না।  

জয়দেব সরকার নামের আরও এক কারিগর বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের তৈরি বেতের বিভিন্ন সামগ্রী আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালিতেই বেশি যায়। তবে গত দুই বছর আগে ভালো অর্ডার ছিল। এখন অর্ডার অনেকটাই কমে গেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে এখন বেশি বেতের পণ্য যাচ্ছে বিদেশে। দিন দিন মূলধন কমে আসছে আমাদের। সরকারিভাবে যদি স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমরা আরও ভালো কিছু করতে পারতাম।

লক্ষ্মী রানী নামের এক নারী শিল্পী বলেন, আমার তিন ছেলে বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে আর আমি তা শুকিয়ে বার্নিশের কাজ করি। এই কাজে যতটা কষ্ট সেই অনুযায়ী মজুরি পাই না। দিন দিন এই কাজের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হচ্ছে আবার অনেকে পেশাও বদল করছে।  

বেত শিল্পের কারিগর নিখিল সরকার বলেন, আমি প্রায় ৫০ বছর যাবত এই বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে এখন আর আগের মতো ভালো নেই। দেশে বেতের সংখ্যাও কমে গেছে, লাভও কমে গেছে, অন্য পেশায় যেতে পারছি না তাই এখনও বাধ্য হয়েই এ কাজ করছি। আমাদের এই কাজে এখন আর নতুন করে কেউ আসছে না কারণ ভবিষ্যৎ নেই। তবে টাকা আর লাইন থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব এই শিল্পে।

ঘিওর বাঁশ-বেত শিল্প উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের অনলাইন প্লাটফর্মের অ্যাডমিন অর্ণপ সরকার বলেন, এই অনলাইন প্লাটফর্ম রান করছে কিছু দিন যাবত। তেমন সারা না পাওয়াতে হতাশ আমরা সবাই। এই প্লাটফর্মে বাঁশ-বেতের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী আপলোড করছি তবে আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় আমরা হতাশ।

বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও নতুনদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দীর্ঘ দিন যাবত আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জেলায় বাঁশ-বেত শিল্পটি প্রসিদ্ধ রয়েছে এবং এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই কুটির শিল্পটিকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাওয়ার চেষ্টা করছি এবং সর্বশেষ বিসিক কর্তৃক একটি মেলার আয়োজন করেছি। সেখানে এই বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য প্রদর্শন করে ছিলাম।  

এই বিসিক শিল্প উন্নয়নের জন্য দুটি ঋণ প্রক্রিয়া রয়েছে। যদি কোনো উদ্যোক্তার প্রয়োজনে তাকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয় বলেও জানান এই বিসিক কর্মকর্তা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, জুন ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।