ঢাকা: বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এরপরও পাইকারি ও খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে দাম বেড়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি দেশি বাসমতি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, মিনিকেট ৬২ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭৮ টাকা, মাঝারি মানের বিআর ২৮ ও ২৯ চাল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা ৫৪ টাকা এবং মোটা হাইব্রিড ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদুল আজহার আগে এসব চালের দাম কেজিতে মানভেদে এক থেকে দুই টাকা পর্যন্ত কম ছিল।
পাইকারি বাজারে বর্তমানে চিকন চালের মধ্যে প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে ৫৯ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭৪ টাকায়। আর দেশি বাসমতি চালের কেজি ৮০ থেকে ৮৪ টাকা।
মাঝারি মানের প্রতি কেজি বিআর ২৮ চাল ৫১ থেকে ৫৩ টাকা, বিআর ২৯ চাল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা, পাইজাম ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি গুটি স্বর্ণা মানভেদে ৪৯ থেকে ৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড মোটা চালের কেজিতে ৪৬ টাকা। ঈদের আগে এসব চালের কেজি এক থেকে দুই টাকা কম ছিল।
পুরান ঢাকার বাবুবাজার চালের আড়তে চাল কিনতে আসা বেসরকারি কর্মকর্তা পলাশ সাহা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে জীবনযাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একটি পণ্য কিনলে আরেকটি কেনার বাজেট থাকছে না। ঈদের ছুটি কাটিয়ে আসার পর একটু কম দামে চাল কেনার আশায় বাবুবাজার পাইকারি বাজারে এলাম। কিন্তু এসে দেখি বস্তায় ৫০ টাকা করে বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে। আমরা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কোথায় যাব?
নারিজশাইলের ৫০ কেজির বস্তা কেনেন পলাশ। তবে বস্তায় জাত বা মিলগেট দাম লেখা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার শুধু মুখেই বলে, বাস্তবায়ন করে না। দাম-জাত লেখা থাকলে আমরা যারা সাধারণ ক্রেতা, তারা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারি। সরকারকে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। বাজারে বাজারে না ঘুরে মিলগেটে যেতে হবে, যেখানে চাল উৎপাদন হয়, সেখানে যেতে হবে।
বাবুবাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা মেসার্স রশিদ রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, চালের বাজার গত এক দেড় মাস ধরে স্থিতিশীল ছিল। কারণ এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে সরবরাহও ভালো ছিল। ঈদের পর হঠাৎ চালের দাম বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন কিছু মিলমালিক। এতে বাজারে চালের সরবরাহ কিছুটা স্থবির।
তিনি জানান, বাজারে এখন আমদানিকৃত চাল নেই। কারণ, এখন এলসির চালের থেকে দেশি চালের দাম কম। সব মিলিয়ে কিছু মিলমালিক সুবিধা নিতে চাইছেন। ঈদভাঙা বাজার পুরোপুরি চালু হলে এটা থাকবে না বলে মনে করছেন তিনি। বাজারে সরবরাহ ভালো থাকলে চালের দাম আর বাড়বে না বলে আশা করছেন তিনি।
বস্তায় ধানের জাতের নাম-দাম লেখা থাকছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বস্তায় ধানের জাতের নাম, দাম লেখা সবাই চালু করেনি। দুই-একটি কোম্পানি চালু করেছে। যারা বাকি, তারা সময় চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। আসলে ধানের জাত লেখা থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মিলগেটের দাম লেখা থাকলে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়।
এ পাইকারি বিক্রেতা সমস্যার উদাহরণ টেনে বলেন, ধরুন আজ আমি যদি ৫০ কেজির চালের বস্তা তিন হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে আনি, গাড়িভাড়া, লেবার খরচসহ অন্যান্য খরচ যুক্ত করে তিন হাজার ৫২০ টাকা বিক্রি করছি। আগামীকাল যদি বস্তায় ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা কমে যায়, তাহলে আমার চাল আর আগের দামে বিক্রি হবে না। আর যদি বেড়ে যায়, তাহলে আমি নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করতে পারব না।
বাবুবাজারের মেসার্স হাজী রাইস এজেন্সির মালিক মো. জিয়াউল হক বাংলানিউজকে বলেন, বস্তায় ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। ধানের বাজার বেড়েছে। এ ছাড়া আমার কাছে যা মনে হয়, ঈদের কারণে অনেক মিল বন্ধ থাকায় বাজারে সরবরাহ কমেছে। এ সুযোগে মিলগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এ দাম বেশিদিন থাকবে না। সবকিছু পুরোদমে চালু হলে দাম কমে যাবে।
বাবুবাজারের পাইকারি আড়তদার দয়াল ভাণ্ডারের ম্যানেজার সাঈদ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে নতুন চাল আসার পর দাম অনেকটা কমে যায়। গত দেড় মাস ধরে বাজার স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ঈদের পর দাম বেড়েছে।
রায়সাহেব বাজারের খুচরা চাল-বিক্রেতা মো. রাজু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ঈদুল আজহার পর চালের দাম কেজিতে এক টাকা করে বেড়েছে। এক-দেড় মাস ধরে চালের বাজার স্থিতিশীল ছিল। ঈদের পর আড়তে গিয়ে দেখি প্রতি বস্তায় দাম ৫০ টাকা করে বেড়েছে। তবে এ দামটা হয়তো এক সপ্তাহ থাকবে। ছুটির আমেজ শেষ হলে এবং সবকিছু আগের মতো সচল হলে দাম আবার আগের মতো হবে।
সূত্রাপুর বাজারের মেসার্স আদনান অ্যান্ড আরাফাত ট্রেডার্সের মালিক মো. ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের পর প্রকারভেদে প্রতি বস্তা চালের দাম ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে আমি আগের দামেই বিক্রি করছি। নতুন করে চাল কেনা হয়নি। কম দামে কেনা তাই কম দামেই বিক্রি করছি। দীর্ঘ দিন ধরে চালের দাম স্থিতিশীল ছিল। ঈদের পর কেন জানি দাম বাড়ল।
ধানের জাত ও মিলগেট মূল্য লেখা চালের বস্তা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাজারে তিন-চারটি কোম্পানির বস্তার গায়ে চালের জাত ও দাম লেখা থাকছে। কিন্তু এতে আরেক বিড়ম্বনা তৈরি হচ্ছে। আমাদের বেশি দামে কেনা হলেও ক্রেতারা বস্তায় লেখা দাম দিতে চান। এতে আমরা ঝামেলায় পড়ে গেছি।
এ বিষয়ে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, গত এক-দেড় মাস ধরে চালের দাম স্থিতিশীল ছিল। ঈদের পর সব কিছু বন্ধ ছিল। এ জন্য হয়তো এক টাকা এদিক-সেদিক হয়েছে। তবে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। কেউ যাতে কারসাজি করে অতিরিক্ত মজুত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এবার বোরোতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ কোটি ২২ লাখ টন।
সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুধু হাওরে চার লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। আর তাতে ৫০ হাজার টন বেশি উৎপাদনও হয়েছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে বোরো ধান কাটা উৎসবে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ বলেন, আমাদের সারা বছরের মোট চাল উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি যোগান দেয় বোরো ধান। সেজন্য এ বছরও বোরোর আবাদ ও ফলন বাড়াতে আমরা অনেক গুরুত্ব দিয়েছি। বোরোর আবাদ বাড়াতে ২১৫ কোটি টাকার বীজ, সার প্রভৃতি কৃষকদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৪
জিসিজি/আরএইচ