ঢাকা: কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
একই সঙ্গে তারা বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে যে পরিবর্তনটা হলো সেটা যদি ভালো খাতে বা ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে দেশের জন্য ভালো হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির যে খাতগুলো জটিল হয়ে গেছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। আমাদের বিনিয়োগ কমে গেছে, বিদেশি বিনিয়োগও আগামীতে বাড়বে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। আর অর্থনৈতিক সূচকগুলো কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নির্ভর করছে পরবর্তী সরকারের পদক্ষেপে ওপর। গত এক মাস সময় ধরে চলা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে যে পরিবর্তনটা হলো সেটা যদি ভালো খাতে বা ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে দেশের জন্য ভালো হবে। আমরা যদি সত্যি সত্যি দুর্নীতি কমাতে পারি, পলিসিগুলো ব্যক্তি স্বার্থের পরিবর্তে দেশের স্বার্থে করতে পারি তাহলে অবশ্যই ভালো একটা রেজাল্ট আসবে। তবে এটা নির্ভর করবে পরবর্তী যে সরকার আসবে তারা কীভাবে দেশটাকে ম্যানেজ করবে তার ওপর।
তিনি বলেন, আমার মতে পরবর্তী সরকার গঠন করতে হলে সেখানে কিছু পলিটিক্যাল এক্সপার্ট থাকবে তারা সংসদীয় কিছু বিষয় রিভিউ করবেন। আর কিছু লোক থাকবেন যারা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করবেন।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ার সেটা পড়ে গেছে। সেটা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। সামগ্রিক অর্থনীতিতে আমাদের প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আগে জুলাই মাস পর্যন্ত যেটা ছিল লাখ কোটি টাকা। পরবর্তী কয়েকদিনে সেটা আরো বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সর্বমোট এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সেনা সমর্থিত সরকার হলে বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সেটা করছি না। কারণ যদি সরকার পরিবর্তন না হতো তাহলে সরকার হয়তো আরো রক্তের বন্যা বইয়ে দিতো। তখন কিন্তু দেশের অবস্থা আরো খারাপ হতো, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো এই সরকারকে কেউ গ্রহণ করতো না।
তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তনটা হওয়া দরকার ছিল। তবে আমরা নতুন যে সরকার হবে সেটা সেনা সমর্থিত হোক চাই না। সেখানে সিভিলিয়ান সরকার হবে সেটাই আমাদের আশা। যে সরকারে টেকনোক্র্যাট লোকজন থাকবে। কারণ দেশটাকে টেকনিক্যালি সামনের দিকে নিতে হবে। এজন্য টেকনিক্যাল লোকজন প্রয়োজন। তারা দেশটাকে ঠিকঠাক করে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তারপর আবার একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি ভালো হওয়া বা স্বাভাবিক হবে নির্ভর করবে যদি কিছুটা দুর্নীতি কমে, টেকনোক্রিয়েটিভ সরকারের নেচার যদি তারা দেখাতে পারে তাহলে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে। সেটা নির্ভর করবে নতুন সরকারের ওপর। সরকার কী করতে চায়, ভেতরের লোকজন কী রকম,তারা কতখানি দক্ষ, কতখানি রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত সেটার ওপর। কাজটা কঠিন তবে করা সম্ভব।
সরকার পতনের পরও যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে সে বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা মোটেও কাম্য নয়, এখানে সামরিক বাহিনীর সুরক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। একই সাথে রাষ্ট্রীয় কোনো ভবন যেমন, গণভবন, সংসদ ভবন এগুলো সব আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ কোনোভাবেই এগুলো ধ্বংস করতে দেওয়া উচিত নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখিত, কারণ এগুলি আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। গণভবন তো শেখ হাসিনার নয়; এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সংসদ ভবন আমাদের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ, মন্দির, মসজিদ ধ্বংস এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। রপ্তানিকারকদের অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে, নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছে না। বায়ররাও বাংলাদেশকে নিয়ে পুনঃবিবেচনা করবে। এসব বিষয় নিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির একটা বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। সংখ্যার হিসেবে আমরা এটা দেখতে পারবো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আস্থাহীনতার। আমরা যতোদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক জায়গায় যেতে না পারবো ততোদিন পর্যন্ত এই অর্থনীতির ক্ষতিটা চলতেই থাকবে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া অর্থনীতির যেসব খাতে আমরা উন্নতি আশা করেছিলাম সেটা করতে আরো দেরি হবে। আপাতত দৃষ্টিতে সমস্যা শেষ হলেও এই সমস্যাটা আরো এক দেড় মাস টেনে নিতে হবে। আবার নতুন সরকারের বিদেশি অর্থায়ন, অর্থ সংগ্রহ, বিনিয়োগ এগুলো কঠিন হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসের শুরু থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি নামানো হয়। একপর্যায়ে সরকার গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে। একই দিনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। এখনো বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।
এর আগে শনিবার (৩ আগস্ট) শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পাশাপাশি রোববার (৪ আগস্ট) দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারপর ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বিক্ষোভ থেকে ৫ আগস্ট লং মার্চ কর্মসূচি দেন তারা।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অসহযোগ আন্দোলনকে সামনে রেখে তিনি কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
কর্মসূচিগুলো হলো-অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি রোববার সব জেলা, উপজেলা, পাড়ায়, মহল্লায় বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান; সব খুনের বিচার ও সব রাজবন্দিকে মুক্ত করা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পক্ষে সব ক্যাম্পাস ও হল খুলে দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন তিনি।
এরপর ৫ আগস্ট সোমবার লংমার্চ শুরু হলে বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এ সময় তার সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন। এরইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এদিন বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে গণভবনে প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০২৪
জিসিজি/এসএএইচ