তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির একদিকে উন্নতি হচ্ছে, রপ্তানির ইতিবাচক ধারাও অব্যাহত। অন্যদিকে দেশের পোশাকশিল্পে অস্থিরতা চলছে।
বাংলানিউজ: তৈরি পোশাকশিল্পে অস্থিরতা চলছে, এর মধ্যেও রপ্তানি ইতিবাচক ধারাতে আছে দেখা যাচ্ছে। তাহলে সামনে কী দেখছেন?
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: তৈরি পোশাকশিল্পে এখন যে অনিশ্চয়তা আছে, সেগুলো দূর করে... আইনের শাসন, শ্রমিক ইস্যুগুলো গুছিয়ে আমরা যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে ২০২৫ সালে আমাদের ব্যবসাতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি আসবে। এগুলোর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, চীন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য সরে যাচ্ছে। আরেকটি হলো, যেসব দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অবস্থা ফিরে এসেছে, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর একটি ইতিবাচক অবস্থা ফিরে এসেছে; সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থাতে স্থিতিশীলতা আসছে। আগামীতে আরও চাঙ্গা হবে। এর সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হওয়ার মতো সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ইউরোপের দেশগুলোতে। সব কিছু মিলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক দিকগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা ও চীন থেকে ব্যবসা বাংলাদেশে আসছে। এর ফলে অক্টোবর-নভেম্বরে ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলছে। আমার ব্যক্তিগত ব্যবসার কথাও যদি ধরি, আমার ফ্যাক্টরিগুলোতে বুকিং পরিস্থিতি ভালো। কার্যাদেশ ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে।
বাংলানিউজ: আগস্ট থেকে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। এ সময় বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়। সব মিলে পোশাকশিল্পে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। এখন কী মনে করছেন, সেই পরিস্থিতি দূর হবে?
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: আসলে অনিশ্চয়তা দূর হবে তখনই, যখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। আমরা দেখছি, শিল্প পুলিশ এখনো আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারেনি। সরকারের উচ্চমহল থেকে দিকনির্দেশনা যেভাবে থাকার কথা, এখনো তার কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। এ কারণে কারখানার ছোট্ট ইস্যুগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন দেখা গেছে, ৩০-৪০ জন শ্রমিকের বকেয়া বেতনের জন্য কারখানায় এসেছে। তারা নিজেরা কথা বলেছে, স্থানীয় প্রশাসন সাহায্য করেছে—এভাবে তারা বেতন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেছে। এখন সেটা প্রলম্বিত হচ্ছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে গাইডেন্স ছিল, এখন সেটা নেই। এটা না থাকার কারণে শ্রমিকরা অল্পতেই রাস্তায় নেমে যাওয়া, ভাঙচুর করা—এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যারা এটা করছে বলা হচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। যে আমার ফ্যাক্টারি পোড়াতে আসবে, যে আমার গ্লাস ভেঙে ফেলবে, তাকে আমি কিছু বলতে পারব না, এটা হতে পারে না। আইন সবার জন্য হওয়া উচিত।
আইন শুধু শ্রমিকের জন্য, আইনের জন্য না—এই পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারা যদি গভীরভাবে না দেখেন, তাহলে এই অবস্থা আরও বাড়তে থাকবে, একটা অভ্যাসে পরিণত হবে। আজকে কিছু লোক করছে, কাল আরও অনেকে করবে। যেটা আমি এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও দেখছি, আবদারের শেষ নেই। এই অনিশ্চয়তা কেন এবং কীভাবে দূর হবে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলানিউজ: এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের পোশাকশিল্পের বাজার প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী অন্য দেশে চলে যাবে—একটি বক্তৃতায় আপনি এমন আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, এমনটা কেন মনে হলো?
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: প্রতিবেশী ভারতে ব্যবসা চলে যাবে কি না বা চলে যাচ্ছে কি না—এটা আসলে প্রপাগান্ডা। তৈরি পোশাকশিল্পে গত ৪০ বছরে আমাদের যে স্ট্রেংন্থ (শক্তিমত্তা) এসেছে, এটা ভারতের নেই। ভারতের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে শ্রম পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। আমাদের শ্রম পরিস্থিতিতে যে শক্তিমত্তা এসেছে, ভারতের তা নেই। ভারত হয়তো প্রণোদনা দিচ্ছে, হয়তো অবকাঠামোগত সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের শ্রমিকের মনোভঙ্গির প্রান্তিককরণ (Alignment) ঠিক করতে পেরেছে। শ্রম ও সক্ষমতা হলো আমাদের সক্ষমতা। এই দুই সক্ষমতা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা ২০৩০-২০৩৫ এর মধ্যে পোশাক রপ্তানিতে প্রথম অবস্থানে চলে যেতে পারব।
বাংলানিউজ: প্রথম হওয়া মানে তো একশ বিলিয়ন রপ্তানি করতে হবে!
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের যে নীতি সহায়তাগুলো দরকার, আমাদের সরকার যদি সেগুলো সঠিকভাবে দেয় তাহলে আমাদের একশ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের যে লক্ষ্য, সেটা আসলেই সম্ভব।
বাংলানিউজ: আপনি বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি হয়নি, হচ্ছে না। তাছাড়া শ্রমিকরা সহিংসতায় গেলে এটা রোধে আইনি শক্ত অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। এটা যদি চলতে থাকে, পাশাপাশি শ্রম সংস্কার কমিশনে যে কথাগুলো আলোচনা হচ্ছে—এই দুটি যদি এক জায়গায় করা হয়, তাহলে তৈরি পোশাক রপ্তানির যে লক্ষ্যের কথা বলছেন, সেটা অর্জন সহজ হবে?
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: সেখানে দুটি পয়েন্ট আছে, সেটা আমি বলি। ধরুন, একটি সংস্কৃতি ছিল যারা সমস্যা সৃষ্টিকারী তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। গ্রেপ্তার করে, তদন্ত করে যারা আসলেই সাজা পাওয়ার মতো তাদের সাজা দিতে হবে। তাহলে তারা আর ষড়যন্ত্র করতে সাহস পাবে না। এটা আমাদের একটি পথ ছিল। এখন কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার বা ভবিষ্যতের সরকার যদি মনে করে, এটা শ্রম আইনের পরিপন্থি তাহলে এই কালচারের আগে ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। তারপর এই আইনটিকে ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে।
শ্রমিককে যদি অধিকার ও দায়িত্ব বোধ না বুঝিয়ে তাদের রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো তারা ভাঙচুর করবেই। একজন শ্রমিক একটি কারখানায় ১০-১৫ বছর কাজ করে। যদি তাদের বোঝান, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বোঝান—ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার তাদের আছে; একই সাথে তাদের দায়িত্বশীলতা বোধেও মনোযোগ দিতে হবে। একটি কারখানাতে যখন ৫ বছর, ১০ বছর কাজ করছে, তখন তার ওই কারখানাতেও কিছু দায়িত্বশীলতা তৈরি হওয়া দরকার।
বাংলানিউজ: এ ক্ষেত্রে তো উদ্যোক্তাদেরও ভূমিকা রয়েছে।
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: হ্যাঁ, আমাদের মালিকদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। মালিকরা টেকনোলজি, এনহ্যান্সমেন্টেই শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছে। তাদের উচিত লেবার রাইট অ্যান্ড লেবার রেসপন্সিবিলিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনশিপ এবং তাদের যে ওনারশিপের ব্যাপার আছে, সেটাও করতে হবে। একটা ফ্যাক্টরি তাদের রিজিক দিচ্ছে, তাই নিজেদের মতো করে বাইরের লোক থেকে রক্ষা করবে। বাইরের ৫০ জন লোক এসে টাকা-পয়সা দিলেই সে বিক্রি হয়ে যাবে না, এই মূল্যবোধগুলো যত বেশি শেখাতে পারব, এই ধরনের পরিস্থিতি তত কম হবে। আমরা এটাও মনে করি, সরকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের অফিসে বসে না থেকে মাঠ পর্যায়ে কারখানায় কারখানায় গিয়ে পরিদর্শন, তদন্ত, প্রশিক্ষণ দেওয়া, সক্ষমতা তৈরি ও মনোভঙ্গি তৈরি করতে পারে। এটা যত ভালোভাবে করা হবে তত বেশি চ্যালেঞ্জগুলো কমে যাবে।
রানা প্লাজা ইস্যুর পর ২০১৪ থেকে ২০২৪ এই ১০ দশ বছরে আমরা পরিপূর্ণভাবে এবং সেক্সুয়্যাল হ্যারেজমেন্ট—এই সব জায়গায় আমরা যতটুকু নিরাপত্তা দিতে পেরেছি; কিন্তু শ্রমিক বা মধ্যবর্তী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সেগুলো আমরা শক্তভাবে বলতে পারব না। এখনো সেগুলো করার সুযোগ আছে। শ্রমিক ইস্যুতে আইএলও কনভেনশন ১৯০ বলি বা আইএলও কনভেনশন ৮৭ বলি, এগুলো যত ইমপ্রুভ করব, সেগুলোর জন্য ফলও পাবো। ২০১৪-২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে আমরা অগ্নি নিরাপত্তা ও পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ করেছি। এতে আমাদের ব্যবসাও বেড়েছে। এই সময়ে আমাদের ব্যবসা ১৬ বিলিয়ন থেকে ৪৮ বিলিয়নে চলে গেছে। লেবার ইস্যুতেও যদি আমরা বিনিয়োগ করতে পারি তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাংলাদেশে আরও ভালো ভালো ব্র্যান্ড আসবে। তখন শ্রমিক সূচকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলি, যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলি, উচ্চ পর্যায়ের ব্র্যান্ডগুলোর কথা বলি, তারা আরও বেশি বেশি করে আসবে। আর আসতে তাদের হবেই, কারণ চীন থেকে যদি তারা বেরিয়ে যায় তাহলে বিকল্প হাব তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেটা হবে বাংলাদেশ।
এখানে আমি যেটা বুঝি, একটি কাস্টমারের, মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় শ্রমিক ইস্যুর মতো ইস্যুগুলোকে আমরা সক্ষমতার সাথে মোকাবিলা করতে পারব।
বাংলানিউজ: ইতোমধ্যে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে...
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: আমাদের এখন ছোট্ট কারখানাগুলোতে যেসব সমস্যা হচ্ছে, এসব কারখানার এক একটিতে শ্রমিকের বেতনের পরিমাণ কিন্তু কম না। কারো দুই কোটি, তিন কোটি, ১০ কোটি বা ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত। জুলাই-আগস্ট পরবর্তী এই ফ্যাক্টরিগুলোতে কিছু ড্যামেজ হয়েছে। তাদের পে-রোলে সমস্যা হচ্ছে। সরকারের উচিত এই ছোট থেকে মাঝারি ফ্যাক্টরিগুলোকে ট্রানজ্যাকশনাল সার্পোট দেওয়া। তাহলে তারা কন্টিনিউ করতে পারবে। এটা তাদের ক্যাশ ফ্লোতে সাপোর্ট হতে পারে। তাহলে এই কারখানাগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং কর্মসংস্থানও টিকে যাবে। তাহলে অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ বাড়বে, রপ্তানি বাড়বে এবং এর সাথে সাথে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, যেটা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন।
আবার শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো কথা বলা হয়েছে। রিভিউ করা হয়েছে। সেটা হয়তো মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের শ্রমিকরা মুখোমুখি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি তো আসলে সব খাতের জন্যই। এখন একটি সেক্টরের বেতন বাড়াতে ইমব্যালান্স পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, পরে অন্য সেক্টরে আর শ্রমিক পাওয়া গেল না, সেটাও আসলে ভেবে দেখা দরকার।
এইসব ফ্যাক্টরিগুলোকে যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি, এইসব কারখানাই আমাদের একশ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি অভীষ্ট পূরণ করবে।
বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ হিল রাকিব: বাংলানিউজকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪
এমজেএফ