ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

আইএমএফের শর্তে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

খেলাপি না হতে ব্যবসায়ীরা ছয় মাস সময় চান 

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫
খেলাপি না হতে ব্যবসায়ীরা ছয় মাস সময় চান 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানায় বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে কম সময়েই খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁরা মনে করেন, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য আগের মতো অন্তত ছয় মাস সময় দেওয়া উচিত।

আইএমএফ বলছে, কেউ তিন মাসের মধ্যে ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে তা খেলাপি হয়ে যাবে। এতেই আপত্তি ব্যবসায়ীদের। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। সংস্থাটির শর্ত মেনে হিসাব করায় অনেকেই খেলাপি হয়ে পড়ছেন।

ফলে খেলাপি ঋণ এখন সর্বকালের শীর্ষে অবস্থান করছে। মোট ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে দুই লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি, যা বিতরণ করা ঋণের ১৭ শতাংশ।

ঋণখেলাপি হওয়ার সময় তিন মাস না করে আগের মতো ছয় মাস করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একইভাবে এক্সিট পলিসির আওতায় বড় শিল্পঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য ১.৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট, দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় চেয়েছেন তাঁরা।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পঋণ পরিশোধের জন্য ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট, দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর সময় দরকার বলে মত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে খেলাপি করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। আবার আগামী মার্চ (২০২৫) মাস থেকে একটি কিস্তি (তিন মাস) পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই খেলাপি করা হবে।

তিনি আরো বলেন, নীতি সুদহার বাড়া মানে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়া।

নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ঋণ ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনে কোনো পরিবর্তন না এনে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এক নির্দেশনার মাধ্যমে কৌশলে খেলাপি কম দেখানোর সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরামর্শে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, মেয়াদি ঋণ বকেয়া হিসাবের ক্ষেত্রে বাড়তি ছয় মাস সময় পাবে। এর মানে, কিস্তি পরিশোধের শেষ তারিখের ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ গণনা করা হবে। এই নিয়মে প্রকৃতপক্ষে এক বছর পর খেলাপি হয়। গত বছরের (২০২৪) সেপ্টেম্বর প্রান্তিক থেকে তিন মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ গণনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আগের মতো নির্দিষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে আদালতে গেলেই স্থগিতাদেশ পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঢালাওভাবে কোনো বিশেষ সুযোগ দিচ্ছে না। নিয়ম কঠোর করার কারণে খেলাপি ঋণ এক লাফে অনেক বেড়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে, গত ডিসেম্বরে যেখানে খেলাপি ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।

গত রোববার বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সংগঠনের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করে এমন দবি করেছে। তাঁরা এখন নতুন করে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না বলে ওই বৈঠকেই জানিয়েছেন।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পাঁচ মাস পার হতে চললেও দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিবেশ এখনো ফেরেনি। বরং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং সংস্কার, নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতায় নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা।

গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে, ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি—সব কিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না। উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। নতুন গ্যাস সংযোগে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আবার আইএমএফের সুপারিশে বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর-মূসক বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ।

আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপের দায় অন্য ব্যবসায়ীদের নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোরও এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ক্যাশ ইনসেনটিভ না পেলে ইন্ডাস্ট্রিগুলো মরে যাবে।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সিঙ্গল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমার মনে হয়, এটা আগের মতো ৩৫ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। তাই খেলাপি না করার জন্য মেয়াদ ছয় মাস রাখার প্রস্তাব করেছি। ’

একটি প্রতিষ্ঠান এক্সিট সুবিধা নিয়ে পরে কিভাবে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার-উল-আলম সাংবাদিকদের বলেন, একজন ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকে। সব প্রতিষ্ঠানই একসঙ্গে খারাপ হয়ে যায় না। যে প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়েছে তার দায় পরিশোধের জন্য অন্য ভালো প্রতিষ্ঠানের আয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পশ্চাদসংযোগ শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর নতুন সূর্য সবার গায়ে লেগেছে। আমরা চাই, সবাই দেশের জন্য কাজ করব। কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় যেটা দেখছি তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে ৭৫ টাকা করা হবে। অথচ আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা তৈরির কথা বলছি। কিন্তু ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দারের মতো কিভাবে দেশের জন্য লড়াই করবে? এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিশ্ববাজারে টিকতে পারব না। ’

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণে নতুন নিয়ম চালু করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নিয়ম অনুসারে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর সব ধরনের ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হবে। বর্তমানে এ সময়সীমা ছয় মাস।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সিএমএসই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই খাত টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, সিএমএসই খাতের বিশেষ তহবিল এবং নিম্ন সুদহারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই খাতে একটি জেলা বা একটি ক্লাস্টারকে পাইলট ধরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অর্থায়ন করা যেতে পারে।

ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এপ্রিলে খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম চালু হলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তার ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ, শ্রমিকের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিকে ব্যবসার অন্তরায় হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, এলসি জটিলতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি সুদের হারও কমাতে হবে।

ব্যাংক রিফর্ম কমিটিতে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্তি এবং অ্যাগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিকে গুরুত্ব দিয়ে সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করার দাবিও জানান ব্যবসায়ী নেতারা।

এদিকে আইএমএফের চাপে ইন্টারনেটসহ ৬৭ পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই তালিকায় রয়েছে ওষুধ, এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সিগারেট, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল সেবা ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এ ছাড়া টার্নওভারের তালিকাভুক্তি ও ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাটের বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে, যা ব্যবসার পরিচালন খরচ বাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।