ঢাকা: নজরুল ইসলাম, থাকেন সৌদি আরবে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গত জুনে দেশে ফেরেন এই প্রবাসী।
তবে প্লেনে চড়ার আগে ৪ ডিসেম্বর বিমানবন্দরে ঘটে বিপত্তি। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ফ্লাইটের সময় অনুযায়ী টিকিটসহ প্রবেশ করেন বিমানবন্দরে। তবে এ সময় জানতে পারেন তার ফ্লাইটের সময় রাত ১টা ৪৫ মিনিটে, অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা পরে।
নিজের কাছে নগদ টাকা না থাকায় এই পরিস্থিতিতে নজরুল গ্রামের বাড়ি থেকে মোবাইলের মাধ্যমে চার হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। টাকা সংগ্রহ করেন বিমানবন্দরের পাশেই অবস্থিত বিকাশের এক এজেন্ট এর মাধ্যমে। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিটে (৫ ডিসেম্বর) বিমানে চেপে সৌদি আরব পাড়ি জমান তিনি।
ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই, ৫ ডিসেম্বর ভোরে একটি মোবাইল (মোবাইল নম্বর- ০১৭৮৯০৫৯৩৫২) ফোন থেকে নজরুলের গ্রামের বাড়িতে ফোন দেওয়া হয়। ফোনে তার পরিবারকে জানানো হয় নজরুলের বিমানের টিকিটসহ ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। নতুন করে টিকিট করতে তার এখনি ৭০ হাজার টাকা প্রয়োজন। নজরুল অচেতন অবস্থায় বিমানবন্দরের মধ্যে পড়ে আছেন।
এ পরিস্থিতিতে নজরুলের মোবাইল ফোন বন্ধ (বিমানে থাকার কারণে বন্ধ) থাকার কারণে প্রতারকের (ফোনকারী) কথা বিশ্বাস করে চারটি মোবাইল নম্বরে (মোবাইল নম্বর-০১৭৯০০৮৬৫২৭, ০১৭৯০০৮৬৫৩১, ০১৮৫৭৩৬০৮৯৬ এবং ০১৭৮৯০৫৯৩৫২) ৭০ হাজার টাকা পাঠায় নজরুলের পরিবার। পরে তারা জানতে পারেন এ টাকার সম্পূর্ণ অংশ তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এমন প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৭ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন নজরুলের বড় ভাই মো. খোরশেদ।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র। জানা গেছে, রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে একটি বিশাল মোবাইল প্রতারক চক্র। এ চক্রের মূলে রয়েছেন গাজীপুরের তরিৎ পাড়ার জাবেদ হোসেন।
অভিযোগ রয়েছে, জাবেদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এক সময় গাজীপুরের উত্তর বিলাশপুর ভাড়া বাড়িতে থাকতেন জাবেদ হোসেন। বর্তমানে তিনি গাজীপুরের তরিৎ পাড়ার ‘জ্যোতি ভিলা’ নামের নিজস্ব বাড়িতে থাকেন।
তরিৎ পাড়ার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর খানেক আগে পেস্ট কালারের জ্যোতি ভিলা নামের একতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি তৈরি করেন জাবেদ। তাদের ভাষ্য মতে, বাড়িটি তৈরি করতে (জমি ক্রয়সহ) কমপক্ষে এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এলাকাবাসী জানেন জাবেদ হোসেন বিমানবন্দরে সাংবাদিকতা করেন। পাশাপাশি ফিল্ম তৈরির সঙ্গে জড়িত। তবে জাবেদ কোন পত্রিকার সাংবাদিক তা এলাকাবাসী জানে না। তবে ইংরেজিতে press লেখা লাল রঙের একটি পালসার মোটরবাইকে ঘুরে বেড়ায় এই মোবাইল প্রতারক।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গাজীপুর সদরের ভাওয়াল বুক সেন্টার থেকে মোবাইলে নামে-বেনামে অসংখ্য বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলেছেন জাবেদ হোসেন। নিজ নামে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলতে তার ব্যবহার করা একটি পাসপোর্ট এর নম্বর এক্স ০৪০০৭৩৪। এই পাসর্পোট অনুসারে তার পিতার নাম আব্দুল জব্বার ও মায়ের নাম জুবেদা খাতুন।
জাবেদ হোসেনের নামে-বেনামে অসংখ্য বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকার কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করেন গাজীপুরের ভাওয়াল বুক সেন্টারের বিকাশ এজেন্ট খলিল।
তিনি বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে জাবেদ হোসেন প্রায়ই মোবাইলে টাকা তুলতে আসেন। মোবাইলে তার ঘন ঘন টাকা তোলার কারণে আমি (খলিল) একদিন তাকে প্রশ্ন করি ভাই আপনি কি করেন? মোবাইলে আপনার এত টাকা আসে কোথা থেকে? এরপর গত ২০ থেকে ২৫ দিন ধরে তিনি আর আমাদের দোকানে আসছেন না।
গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া ৭০ হাজার টাকার মধ্যে যে মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দেওয়ার হয় সেই নম্বরে নেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। বাকি টাকার মধ্যে ০১৭৯০০৮৬৫২৭ নম্বরে ১০ হাজার টাকা, ০১৭৯০০৮৬৫৩১ নম্বরে দু’বারে ১৭ হাজার (১০ হাজার ও ৭ হাজার) টাকা এবং ০১৮৫৭৩৬০৮৯৬ নম্বরে দু’বারে ১৮ হাজার (১০ হাজার ও ৮ হাজার) টাকা নেওয়া হয়।
এই নম্বরগুলোর মধ্যে ০১৭৮৯০৫৯৩৫২ এবং ০১৮৫৭৩৬০৮৯৬ নম্বর দু’টি নিজ নামে নিবন্ধন করেছেন জাবেদ হোসেন। বাকি দু’টি নম্বর আজগর শেখ নামে নিবন্ধন করা হলেও পরিচয়কারী (রেফারেন্স) হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার করেছেন জাবেদ হোসেন। তবে সেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।
আর নিজ নামে খোলা হিসাবে পরিচয়কারী হিসেবে দেখানো হয়েছে মতিন নামের একজনকে। এতে মোবাইল নম্বর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ০১৭৭৯৯৯৯১৯৪।
ভাওয়াল বুক সেন্টারের মালিক খলিল জানান, ০১৭৭৯৯৯৯১৯৪ মোবাইল নম্বরটিও ব্যবহার করেন জাবেদ হোসেন নিজেই। এই মোবাইল নম্বর দিয়ে জাবেদ অনেকবার ভাওয়াল বুক সেন্টার থেকে টাকা তুলেছেন।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কোন ধরনের প্রলোভনে পড়ে অথবা প্রাপ্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই না করে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইলের মাধ্যমে কোন ধরণের আর্থিক লেনদেন করা ঠিক না। এ ধরণের লেনদেন করলে প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিং এর কারণে অর্থের লেনদেন এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। যে কোন সময় সমস্যায় পড়লেই মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে পারছেন নিম্ন আয়ের মানুষসহ যে কোন ব্যক্তি।
মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের এমন সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রামের অর্থনীতিতেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর হচ্ছে। গ্রামে এমন অর্থ প্রবাহের ফলে বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অধিকাংশ গার্মেন্টসকর্মী ও রিকশাচালকদের এখন মোবাইলে হিসাব রয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমেই তারা গ্রামে টাকা পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিং’র মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
তবে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইলের মাধ্যমে খুব সহজেই টাকার লেনদেনের সুযোগ থাকায় হরহামেশাই প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। প্রতারকরা প্রতারণা করতে অধিকাংশ সময় টার্গেট করছেন গ্রামের সহজ সরল মানুষকে। প্রতারণার অংশ হিসেবে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে নানান প্রলোভন। আর এ প্রলোভনে পড়েই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ কোন সুবিধা দেওয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে মোবাইল ফোনটিকে। মোবাইল ফোন বন্ধ করলেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এ জন্য সাময়িক বন্ধ থাকা মোবাইল ব্যবহারকারীর পরিবারকে ফোনে জানানো হচ্ছে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তার চিকিৎসার জন্য দ্রুত টাকা প্রয়োজন। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যরা প্রতারকের কথা বিশ্বাস করে মোবাইলের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। একটা পর্যায়ে জানতে পারছেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক এ এফ এম আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, সুবিধা থাকলে তার কিছু অসুবিধাও থাকে। মোবাইল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে অসুবিধার থেকে সুবিধাই বেশি। এর মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজনীয় সময়ে দ্রুত অর্থ সংগ্রহ করে সমস্যা সমাধান করতে পারছেন। তবে কিছু প্রতারণা যে ঘটছে তা মূলত গ্রাহকের অসচেতনতার কারণে। গ্রাহক একটু সচেতন হলেই এ ধরণের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং’র ৯৯ শতাংশই ভাল দিক। বাংলাদেশই প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। এখন এটি সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হচ্ছে। অনেকে আমাদের এ পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এটিকে (মোবাইল ব্যাংকিং) আরও জনপ্রিয় করতে ও প্রতারণার পথ বন্ধ করতে গ্রাম পর্যায়ে যেসব এজেন্ট রয়েছেন তাদের মোবাইল ব্যাংকিং এর সমগ্র নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে পরিপালন করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪