ঢাকা: গ্রাহকের কাছে বিমা পলিসি বিক্রি করে আশানুরূপ প্রিমিয়াম আয় বা ব্যবসা সংগ্রহ করতে পারছে না নতুন অনুমোদন পাওয়া জীবন বিমা কোম্পানিগুলো। ফলে কার্যক্রম চালু রাখতে কোম্পানিগুলোকে মূলধন ভেঙে খেতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যে নতুন অনুমোদন পাওয়া সবকটি জীবন বিমা কোম্পানি ৪ কোটি টাকা মূলধন ভেঙে খেয়েছে। নতুন করে আরো ৫টি কোম্পানি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে পরিশোধিত মূলধন থেকে টাকা উত্তোলনের আবেদন করেছে।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বেস্ট লাইফ, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ, আলফা লাইফ, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ ও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ।
কোম্পানির কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে পরিশোধিত মূলধন থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়ার দাবি জানিয়ে কোম্পানিগুলো আবেদনে বলেছে, একই সঙ্গে বেশকিছু নতুন বিমা কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করায় এবং দেশ-বিদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মান বজায় রেখে বিধিবদ্ধ খরচের মধ্যে থাকা দুরুহ ব্যাপার।
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে উত্তোলন করা মূলধনের ৪ কোটি টাকা ব্যবস্থাপনা ব্যয়, কোম্পানির স্থায়ী সম্পদ ও চলতি সম্পদের জন্য ব্যয় হয়ে গেছে বলে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে।
স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মধ্যে রয়েছে আসবাবপত্র ও অফিস ডেকোরেশন, গাড়ী রেজিস্ট্রেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ, মনিহারি, প্রিন্টিং এবং বিমা স্ট্যাম্প ক্রয়। আর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া ও প্রশাসনিক খরচ। মূলধন থেকে উত্তোলন করা টাকার অধিকাংশই খরচ হয়েছে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ।
সূত্রটি জানায়, বেস্ট লাইফ ২০১৩ সালে প্রথম বর্ষে ৪ মাসে ব্যবসা করেছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম বর্ষে ব্যবসা হয়েছে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বছর শেষে কোম্পানির ব্যবসা ১৫ থেকে ২০ কোটি হবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। তবে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ২০১৪ সালের ব্যবসার হিসাব দেয়নি কোম্পানিটি।
কোম্পানিটি লিজ ফিন্যান্সি’র আওতায় গাড়ি কিনেছে ২৫টি। এজন্য প্রতিমাসে কিস্তি বাবদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ১০ লাখ ২৩ হাজার টাকা। আর গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ইন্স্যুরেন্স ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছে ৫১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
মূলধনের টাকা থেকে কোম্পানিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাত, অফিস ভাড়া ও প্রশাসনিক খরচে ব্যয় করেছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এছাড়া অসবাবপত্র ও অফিস ডেকোরেশনে ২৫ লাখ টাকা, মনিহারি ও প্রিন্টিং ৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, বিমা স্ট্যাম্প ৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, অগ্রীম ভাড়া ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সম্পদে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেস্ট লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, নতুন জীবন বিমা কোম্পানিগুলোকে এখন ১০০ টাকার ব্যবসা সংগ্রহ করতে ১২০ টাকার মতো খরচ করতে হচ্ছে। এ পরস্থিতিতে পরিশোধিত মূলধনের টাকা খরচ করা ছাড়া কোম্পানি চালানো দুরুহ ব্যাপার।
তিনি বলেন, একসঙ্গে ১২টি জীবন বিমা কোম্পানি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আসলে এ কোম্পানিগুলোর টিকে থাকাই বড় বিষয়। কারণ বিমা খাতে যেমন দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে, তেমনি রয়েছে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরও। উদ্যোক্তারা এটি বোঝেন না। তারা চান ব্যবসা।
প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ ২০১৩ সালে প্রথম বর্ষে ব্যবসা করেছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যার মধ্যে নবায়নে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। বাকি ২ কোটি ২১ লাখ টাকার ব্যবসা কোম্পানিটি নবায়নের সময় সংগ্রহ করতে পারেনি।
ফলে ২০১৩ সালের প্রথম বর্ষের ব্যবসার অধিকাংশই ভুয়া বলে মনে করছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বেতন-ভাতা ও কমিশন বাবদ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে এ ভুয়া ব্যবসা দেখানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যবসা সংগ্রহের জন্য কোম্পানিটি কমিশন বাবদ খরচ করেছে ৮৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে কোম্পানিটি গাড়ি কিনেছে ১২টি। এজন্য ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এরমধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ৭০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে বিএমডাব্লিও গাড়ি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক’র (এমডি) জন্য ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নিশান পেট্রোল এবং ডিএমডি ও এএমডিদের জন্য কেনা হয়েছে ২৯ লাখ টাকা দামের গাড়ি।
অফিস ডেকোরেশনে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৯ লাখ টাকা। প্রতিমাসে অফিস ভাড়া বাবদ খরচ করা হচ্ছে ৬ লাখ টাকা। এছাড়া বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় করেছে ৪৮ লাখ টাকা।
কোম্পানিতে ডিএমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাঁচজন। এএমডি পদে ১০০ জন, এসভিপি পদে ১৫০ জন এবং ইভিপি পদে ৮০ জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোম্পানির ব্যয় মেটাতে ইতিমধ্যে একটি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা লোন করা হয়েছে।
এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০১৩ সালে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কমিশন দিয়ে প্রথম বর্ষ ব্যবসা করে ২ কোটি ৯৮ হাজার টাকা। যা থেকে নবায়নে আদায় হয় মাত্র ৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রথম বর্ষে ব্যবসার ৯৮ শতাংই প্রতিষ্ঠাটি নবায়নে আদায় করতে পারেনি।
বিষয়টি নিয়ে এনআরবি গ্লোবাল’র চেয়ারম্যান এম এম আহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজী হননি।
ট্রাস্ট লাইফ ২০১৩ সালে কোনো ব্যবসাই করেনি। তবে ২০১৪ সালে ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসুফ আলী মৃধা।
এই বিমা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিমাসে অফিস ভাড়া দিচ্ছে ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কোম্পানিতে গাড়ি কেনা হয়েছে ৯টি। গাড়ি কিনতে প্রতিষ্ঠানটি খরচ করেছে ২ কোটি ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এরমধ্যে চেয়ারম্যানের জন্য ৪০ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে একটি গাড়ি।
মূলধনের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আসবাবপত্র ও অফিস ডেকোরেশনে খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটিতে ডিএমডি পদে রয়েছেন একজন। আর এএমডি পদে ১৩ জন ও সিনিয়র এএমডি পদে রয়েছেন তিনজন কর্মকর্তা।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসুফ আলী মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, এক সঙ্গে অনেকগুলো কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে কোম্পানিগুলোকে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে কোম্পানিগুলোকে কার্যক্রম চালাতে মূলধনের টাকা খরচ করতেই হবে।
তিনি বলেন, সবকটি কোম্পানিকে একসঙ্গে অনুমোদন না দিয়ে ধাপে ধাপে অনুমোদন দেওয়া উচিত ছিলো। তাহলে নতুন অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোকে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি আইডিআরএ কোম্পানিগুলোকে শুনানিতে ডেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে নবায়ন ব্যবসা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে। এতে ব্যর্থ হলে কোম্পানির সনদ বাতিল করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। পাশাপাশি জানিয়ে দেওয়া হয় পরিশোধিত মূলধন থেকে নতুন করে আর কোনো টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হবে না।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রথম দফায় কোম্পানিগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে পরিশোধিত মূলধন থেকে ৪ কোটি টাকা তোলার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে কোম্পানি দাঁড় করাতে এতো টাকা লাগার কথা না। কিন্তু কিছু কোম্পানি ৪ কোটি টাকা খরচ করে আবার দ্বিতীয় দফায় টাকা তোলার জন্য আবেদন করেছে। তবে কোনো কোম্পানিকেই নতুন করে মূলধনের টাকা তোলার অনুমোদন দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৫