লালমনিরহাট: দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া সারে চাষ হচ্ছে বিষবৃক্ষ তামাক। মানা হচ্ছে না তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০১৪ সালে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ১১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর বেড়ে গিয়ে তামাক চাষ হচ্ছে ১১ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া মনগড়া তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় কৃষকরা। তাদের দাবি চলতি বছর এ জেলায় দ্বিগুণ পরিমাণ জমিতে চাষ হচ্ছে তামাক।
কৃষকরা জানান, এ অঞ্চলের জমিতে তামাক চাষে প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ২ কেজি, ফসফেট ২ কেজি, পটাশ পাঁচশ’ গ্রাম, জিপসাম ১ কেজি ও এসওপি ১ কেজি হারে মোট সাড়ে ৬ কেজি সার ব্যবহার করতে হয়।
এ হিসাব অনুযায়ী লালমনিরহাটে বছরে মোট ৩৬ হাজার ৭৫১ মেট্রিক টন সার শুধুমাত্র বিষবৃক্ষ তামাক চাষের জন্যই ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্যবহার হচ্ছে ভিটামিন এবং কীটনাশক। শুধু তাই নয় সরকারের ভর্তুকি দেওয়া ডিজেল ও বিদ্যুত ব্যবহার করে তামাক ক্ষেতে দেওয়া হচ্ছে সেচ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তামাক কোম্পানিগুলো আলুর প্রজেক্টের কথা বলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশে ভর্তুকির শত শত টন সার পাচ্ছে ডিলারদের কাছ থেকে। এসব সার তামাক চাষীদের মাঝে ঋণের মাধ্যমে প্রদাণ করছে কোম্পানিগুলো। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে বলেও সূত্রটি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে। আবার যেসব কৃষক ঋণে সার নিচ্ছেন না, তারা বাজার থেকেই ক্রয় করছে সার।
তামাক চাষে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া সার ব্যবহার হওয়ায় কৃষকরা তামাক চাষে নিরুৎসাহিত না হয়ে বরং উৎসাহিত হচ্ছে। অপর দিকে তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় আশ্বাসের ফলে প্রতি বছর তামাক চাষের ব্যাপকতা বাড়ছে এ জেলায়।
এতে সবজি চাষের জেলা লালমনিরহাটে খাদ্যশস্য ঘাটতির পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। এসব তামাক ক্ষেতে কাজ করছে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। তামাক ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে।
তামাক চাষে কৃষকদের আগ্রহের কারণ হিসেবে চাষিরা জানান, বিগত দিনগুলিতে এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মুলা ও কপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদিত হতো।
আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষে টানা কয়েক বছর ধরে লোকসান গুণে কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছে সবজি চাষে। তারা ঝুঁকে পড়েছেন তামাক চাষে।
এদিকে, তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের তামাক চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ বিনামূল্যে তামাকের বীজ এবং সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে সার, কীটনাশক ও নগদ অর্থ প্রদান করছে। তামাক কোম্পানিগুলোর নিয়োগকৃত সুপারভাইজার ও অফিসাররা প্রতিনিয়ত মাঠে গিয়ে চাষিদের পরামর্শ প্রদান করছেন। বাজারে তামাকের যথেষ্ট চাহিদা থাকায় বিক্রি করতে ঝামেলা হয় না কৃষকদের।
কৃষকদের সুবিধার জন্য কোম্পানিগুলো এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন বড় বড় অনেক ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন।
মূলত কৃষকদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সর্বদাই সজাগ এসব কোম্পানি। তারা নিজেদের চাষি হিসেবে কৃষকদের মধ্যে কৃষক কার্ড বিতরণ করেছে।
এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কৃষকদের অভিযোগ তারা বারবার খোঁজ করেও দেখা পান না উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ না পেয়ে সবজি চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষকরা। কৃষি বিভাগের দায়িত্বের অবহেলার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
আদিতমারী উপজেলার সারপুকুরের রোবেল ও ভাদাইয়ের তামাক চাষি সিরাজুল বাংলানিউজকে জানান, তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তামাক চাষিদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন। অন্যদিকে, সবজি ক্ষেত নষ্ট হলেও কৃষি অফিসের লোকজনের দেখা পাওয়া যায় না। তাই তিনি আলু চাষ না করে তামাকের চাষ করেছেন।
সদর উপজেলার কালমাটি এলাকার তামাক চাষি হবিবর রহমান, নজির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, কোম্পানির তদারকিতে তামাকের আবাদ ভালো হয় এবং চাহিদা ব্যাপক থাকায় মুনাফাও ভালো পাওয়া যায়। অধিক মুনাফার আশায় কৃষকরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে বলে জানান তিনি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সাফায়েত হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৫