বগুড়া: বিক্রি করলেও লোকসান, না করলেও লোকসান। পরিস্থিতির কারণে বিক্রি করে লোকসানের মাত্রাটা কমানোই যেন এখন মূল লক্ষ্য।
সোমবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলাধীন বগুড়া-রংপুর সড়ক ঘেঁষে অবস্থিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক মহাস্থান হাট ঘুরে আগত পাইকারি ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটিই গেছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগর এলাকার ষাটোর্ধ্ব আইনুর প্রামাণিক একটু বেশি দাম পাওয়ার আশায় গিয়েছেন মহাস্থান হাটে। এসে দেখেন, আগত ক্রেতারা ফুলকপি কিনছেন ৭০ টাকা মন দরে। মন ভার করে তিনিও অন্যদের মতোই বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতেও খুব একটা ক্রেতা মিলছে না বলে দুঃখ তার।
পাশেই অপেক্ষমান কপি নিয়ে বগুড়া সদর উপজেলার লাহেরীপাড়া থেকে আসা আরেক বিক্রেতা ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক দেখেছি, এমন কষ্টের সময় পার করিনি কখনও। বহু আশা করে ফুলকপি চাষ করেছিলাম। এখন ইচ্ছে করছে না কপি বিক্রি করতে। কিন্তু না করেও উপায় নেই। বিক্রি করলে ক্ষতিটা তুলনামূলক কম। আর না করলে পুরোটাই ক্ষতি।
এ দুই ব্যবসায়ী জানান, প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন তারা। হিসেব অনুযায়ী এক বিঘা জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন বিঘাপ্রতি কপি বিক্রি করে ৫ হাজার টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু কিছু করার নেই। দেশের এই অবস্থা দ্রুত ঠিক করার অনুরোধ করেন সরকারকে। তবে তৃণমূল সাধারণ কৃষকদের কথা ভেবে দেশের এই চলমান সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনা করে এক হওয়ারও অনুরোধ করেন তারা।
কথা হয় আলু উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা উপজেলার বিহার এলাকার খোকন এবং মাছুদের সঙ্গে। সাংবাদিক শুনেই কিছুটা মন খারাপ হয়ে যায় তাদের। অনেকটা সরল ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেই বসলেন, এখন আপনারা ভাল কথা লেখলেও তো কাজ হয় না, তাই লেখার দরকার নেই। বললেন, এত লেখছেন, তবুও তো দেশে জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস ও সংকট কমছে না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও যেমন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও তেমন। দেশটাকে তারা শান্ত করতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ বোঝানোর পর রাজি হলেন বাজার নিয়ে কথা বলতে। জানালেন, প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বিঘা জমিতে এবার আলু (রুমানা পাক্রী ও কার্টিলাল জাত) চাষ করেছেন তারা। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা। এখন প্রতি বিঘা আলু বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে ৫-৭ হাজার টাকা। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই লোকসানে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
আলুর আড়ৎ মালিক শিবগঞ্জ উপজেলার গনেশপুর মোকামতলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হালিম জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জড়িত জমি মালিকসহ গৃহস্থ ও চাষীরা।
চলমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দোষারোপ করে প্রায় একইরকম কথা বলেন হাটে আগ শিম বিক্রেতা মোকামতলা মাছপাড়ার আব্দুর রশিদ ও জিল্লুর রহমান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতে আগে পাইকারি বাজারে একমন শিম বিক্রি করে পাওয়া গেছে ১২০০-১৩০০ টাকা। এখন হরতাল-অবরোধের কারণে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০০-৩৫০ টাকা।
অপর এক পাইকারী মিষ্টি কুমড়া (মিষ্টি লাউ) বিক্রেতা জানান, পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে ৩ কেজি ওজনের একটি লাউ পাইকারি বিক্রি হতো ৫০ টাকা পর্যন্ত। এখন সেখানে ২০ টাকা বিক্রি করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
টমাটো বিক্রেতা উপজেলার গুজিয়াবাজার এলাকার মইনুল ইসলাম সরকার বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে উপযুক্ত দাম পাওয়া তো দূরের কথা। লোকসানের পরিমাণটা এতটাই বেশি যে, কতদিনে তা পুষিয়ে নেওয়া যাবে, এটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া অঞ্চলের সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, বগুড়া থেকে উৎপাদিত তরকারিসহ শাক-সবজির প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশই জেলার বাইরে অন্য জেলায় চলে যায়। এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা অঞ্চলে চলে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫