ঢাকা: বেঙ্গল ফিশারিজ লিমিটেড কোম্পানির প্রতারণা ও জালিয়াতির কারণে সাগরে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৯ জন নিরীহ মানুষকে। নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ৩১ জন কর্মীর সনদপত্র জালিয়াতি করে প্রতিষ্ঠানটি কৌশলে কাজ করে যাচ্ছিল।
গত বছরের ২৮ নভেম্বর ভোরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে এফবি বাঁধন নামে মাছধরা একটি জাহাজ প্রবল স্রোতের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
ওই দুর্ঘটনায় জাহাজে থাকা ৩১ জনের মধ্যে মাত্র দু’জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিদের কোনো খোঁজ মেলেনি। এছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে স্রোতের কারণে সমুদ্রের তলদেশ থেকে জাহাজটিও আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বেঙ্গল ফিশারিজ লিমিটেডর জালিয়াতির শিকার হয়ে মারা গেছেন মো. মুকতাদির বিল্লাহ। জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথে চলাচলকারী নৌযানের একজন প্রথম শ্রেণির মাস্টার ছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ৫ আগস্ট নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে তিনি এ পদের ‘যোগ্যতা সনদ’ পেয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি চাকরি নেন চট্টগ্রামের বেঙ্গল ফিশারিজ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ গত বছরের ১৬ নভেম্বর মুকতাদিরকে সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন সাজিয়ে ‘এফবি বাঁধন’ নামের ৯৫ দশমিক ৬৭ ফুট দীর্ঘ মাছধরা জাহাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয় গভীর সমুদ্রে।
কেবল মুকতাদিরই নন, তৃতীয় শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারের যোগ্যতা সনদপ্রাপ্ত মো. ইয়াকুব আলী খন্দকারকে প্রথম শ্রেণির প্রধান প্রকৌশলী সাজিয়ে পাঠানো হয়েছিল একই জাহাজে। একইভাবে জাহাজে ছিল আরও কয়েকজন অযোগ্য ও অদক্ষ্য জনবল। সব মিলিয়ে জাহাজে জনবল ছিল ৩১ জন।
এ বিষয়ে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান পরিদর্শক এ কে এম ফকরুল ইসলাম বলেন, ইনল্যান্ড মাস্টারের সার্টিফিকেটধারী কেউ সমুদ্রগামী কোনো জাহাজ চালানোর উপযোগী নয়। কোনো কোম্পানি এমন সার্টিফিকেটধারী কাউকে সমুদ্রগামী কোনো জাহাজে নিয়োগ দিলে তা অবশ্যই অপরাধ। একইভাবে তৃতীয় শ্রেণির কোনো প্রকৌশলীকে প্রধান প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব দেওয়াও অপরাধ। এজন্য কোনো নৌযান দুর্ঘটনাকবলিত হলে, সেই দায় ওই কর্মকর্তাদের নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠান বা জাহাজের মালিকের পক্ষের ওপরই বর্তাবে।
এদিকে ডুবে যাওয়া এফবি বাঁধনের কাগজপত্র খুঁজে দেখা যায়, গত বছরের ১৫ নভেম্বর অনুমোদিত অনবোর্ড মেম্বার্স লিস্টে ৩৭ জনের তালিকা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু ওই জাহাজের পরিদর্শন সনদে দেখা যায়, অনবোর্ড জাহাজে কর্মকর্তা ও ক্রুসহ সর্বোচ্চ ২৯ জন থাকার কথা। অবশ্য পরে ওই তালিকা কাটাকাটি করে ছয়জন ছুটিতে থাকার তালিকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার সময়েও জাহাজে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে দু’জন বেশি ছিল। বাকি ছয়জনের বিষয়ে পরে ছুটিতে থাকার কথা হাতে লিখে দেওয়া রয়েছে। এমন গরমিলের তালিকা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে একজন সরকারি বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাছ ধরার এ রকম বড় জাহাজগুলোর অনুমোদিত জনসংখ্যা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে একজন লোকও বেশি অনবোর্ড করার কোনো সুযোগ থাকে না। কোনো জাহাজে এমনটা করলে তা অবশ্যই অবৈধ কাজ। এছাড়া এসব জাহাজের ওজনও বড় ব্যাপার। সাধারণত এক-দেড় মাসের জন্য এমন জাহাজ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। ফলে এসময়ের জন্য জাহাজে অবস্থানকারী প্রতিজনের খাবারসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদান-উপকরণ সঙ্গে নিতে হয়।
তিনি বলেন, ক্রু লিস্ট বা জাহাজে অনবোর্ড সদস্য লিস্ট যেভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সেটাই অনুসরণ করার কথা। অনুমোদন নেওয়ার পরে ওই লিস্টের মধ্য থেকে কাউকে অন্য বোর্ডে বদলি বা ছুটিতে পাঠানোর সুযোগ থাকে না। আকস্মিক অসুস্থ হলেও তা একাধারে কয়েকজনের ক্ষেত্রে হবে, এমনটা স্বাভাবিক নয়। আবার ২৯ জনের পরিবর্তে ৩৭ জনের তালিকা দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। আর সাধারণ ভেসেলের কোনো কর্মকর্তাকে ফিশিং ভেসেলে নিয়োগ দেওয়া যায় না। কিন্তু ফিশিং ভেসেলের জন্য আলাদা সার্টিফিকেট দরকার হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেঙ্গল ফিশারিজ লিমিটেডের কেবল এফবি বাঁধনই নয়, একইভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ও অনিয়মের মাধ্যমে ওই কোম্পানির ‘এফবি যৌথ উদ্যম’, ‘এফবি যৌথ যাত্রা’ ও ‘এফবি মিতু’ নামের মাছ ধরা জাহাজগুলো চলাচল করছে। ডুবে যাওয়ার সময় এফবি বাঁধনে আইন অনুসারে অনুমোদিত কোনো প্রধান প্রকৌশলী, স্কিপার, ভেসেল মেট বা অন্য কোনো দক্ষ জনবল ছিল না। যা সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় বিদ্যমান ডেক অফিসার সার্টিফিকেশন রুল ২০০৩ কিংবা ফিশিং ভেসেল ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সার্টিফিকেশন রুল ১৯৯২-সহ অন্যান্য আইন ও বিধিমালার লঙ্ঘন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেঙ্গল ফিশারিজের একাধিক সূত্র জানায়, আইন মেনে দক্ষ ও উপযুক্ত প্রকৌশলী ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে তাদের অনেক বেশি বেতন দিতে হয়। তাই কম বেতনে অনুপযুক্ত ও অদক্ষ লোকজনকে ভুয়া পরিচয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। যার পরিণতির শিকার হয়েছে ২৯টি প্রাণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, পুরো বিষয়টি এখনো তদন্তের আওতায় রয়েছে। কারিগরি কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ হয়নি, সময় বাড়ানো হয়েছে। তদন্ত শেষ হলেই প্রতিবেদন অনুসারে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এদিকে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, এফবি বন্ধন নামে মাছ ধরা জাহাজের আগেও ‘এফবি সাল সাবিল’ নামে আরেকটি মাছ ধরার জাহাজ ডুবে যায়। প্রতিবছরই এমন কয়েকটি জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫