ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সরেজমিন মুরগির খুচরা বাজার

ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই দায় খুচরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের

শেখ নাসির হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫
ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই দায় খুচরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের ছবি: কাশেম হারুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের কারণে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে খুচরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের। গত দেড় মাস ধরে অবরোধ-হরতালের কারণে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।


 
বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
 
ব্যবসায়ীরা জানান, মানুষের মধ্যে এখন একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ ভয়ে ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না। ফলে আমাদের বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। আর ঢাকায় পোল্ট্রি ক্রয়ে ধসের কারণে সরাদেশের পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ক্রমাগত আর্থিক লোকসানের কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ দুঃসময় অতিবাহিত করছে।
 
কারওয়ান বাজারের খুচরা পোল্ট্রি বিক্রেতা মা পোল্ট্রি ঘরের মালিক আবুল হোসেন বলেন, ‘ভাই হরতাল-অবরোধে আমাদের ব্যবসা একেবারে শেষ। আমরা এ ব্যবসা আর ধরে রাখতে পারছি না। প্রতিদিনই লোকসান দিতে হচ্ছে। বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। কিন্তু দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ঠিক মতো দিতে হচ্ছে। ফলে গত মাসে অনেক টাকা লোকসান হয়েছে। চলতি মাস শেষে লোকসান আরও বাড়বে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।
 
একই দোকানের কর্মচারী সুজন বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে মানুষ বাজারে আসছে না। আর মানুষ না এলে আমাদের মুরগি কে আর কিনবে? হরতাল না থাকলে দুপুর দেড়টা-দুইটার মধ্যে আমরা গড়ে প্রায় ১২শ’ পিস মুরগি বিক্রি করতাম। কিন্তু আজ (বুধবার) বেলা ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৯০টি মুরগি বিক্রি করেছি। তাহলে বোঝেন আমাদের বিক্রির কোথায় নেমেছে। ’
 
তিনি আরও বলেন, গত মাসে মালিক নিজের সঞ্চয়ের থেকে বেতন দিয়েছেন। চলতি মাসেও বেচাকেনা ভাল না। তাই মাস শেষে বেতন ঠিক সময় পাবো কি-না সে বিষয়েও শঙ্কা থেকে গেছে। আবার এ মুহূর্তে দোকানের কাজ ছেড়ে অন্য কোনো কাজও পাই না। তাই আগামী মাসে যদি বেতন না পাই বা মালিক যদি আর না রাখে তবে পরিবার নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। ’
 
এদিকে, খুচরা বাজারে পোল্ট্রি মুরগির দাম কমেছে কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। অবরোধ-হরতালের কারণে প্রতিকেজি পোল্ট্রি মুরগি (সাদা) বিক্রি করা হতো ১৬০-১৭০ টাকা দরে। কিন্তু এখন তা লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকায়। তাছাড়া লেয়ার (লাল) মুরগি আগে বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ১৮০-২০০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। দাম কমলেও বিক্রি বাড়েনি। অন্য সময় দাম কমলে বিক্রি দ্বিগুণ হয়। কিন্তু এখন বিক্রি অনেক কমে গেছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের খামার মালিকদেরও।
 
তবে কারওয়ান বাজারে খুচরা মূল্য একটু কম থাকলেও শেওরাপাড়া, হাতিরপুল, নিউমার্কেট, পলাশী, বসুন্ধরা এলাকায় একটু বেশি দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে যে পোল্ট্রি মুরগি ১২০-১২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এসব বাজারে তা ১৪০-১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়াও বাজার ভেদেও পোল্ট্রি মুরগির দামে ভিন্নতা আছে। তবে সব বাজারেই মুরগি কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
 
অন্যদিকে মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ও বাজারে মুরগির দাম কমায় উভয়মুখী সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও খামারীরা। যানবাহন চলাচল না করার কারণে বাইরের জেলাগুলো থেকে মুরগি আসছে না। আর যা আসছে তা বিক্রি হচ্ছে না। কারণ শহরের বড় বড় হোটেল বা কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে আগের মতো অনুষ্ঠান হয় না। ফলে তাদের মুরগিও প্রয়োজন হয় না। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের উপর।
 
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের কারণে বিক্রি না থাকায় এ বাজারের দুই ‍খুচরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আমরা কয়েকজন ব্যবসা চালিয়ে নিলেও প্রতিমাসে লোকসান দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। কারণ বিক্রি না হলেও দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন সঠিক সময়ে দিতে হচ্ছে। তবে খরচ কমানোর জন্য চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে দুই কর্মচারীকে ‘না’ বলে দিতে হয়েছে। এভাবে কিছুদিন চললে আমার নিজেরও ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
 
নিউ মার্কেটের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী পলাশ জানান, মানুষ বোমা-আতঙ্কে এখন আর পারতপক্ষে বাজারে আসে না। ঘরের বাইরে বের হলেই এখন ককটেল, পেট্রোল বোমা আর আগুনে পুড়ে মরার ভয়। তাই এখন তারা বাসার নিচ থেকে ভ্রাম্যমান লোকদের কাছ থেকেই মুরগি কেনেন। ফলে আমরা বাজারের ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাছাড়া আগে প্রতিদিনই বড় বড় অর্ডার পেলেও এখন সপ্তাহে একটি বা দুটি অর্ডার পাওয়া যায়--- যারা কমপক্ষে একশ থেকে ৩০০ মুরগির অর্ডার করে। এ ধরনের অর্ডার না থাকায় আমাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
 
মহাখালী থেকে কারওয়ানবাজারে মুরগি কিনতে আসা আসা হাসিবুর রহমান বলেন, আমার একটি ছোট কমিউনিটি সেন্টার আছে। স্থানীয়দের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার কাছ থেকে সেটা ভাড়া নেয়। আগে প্রতিদিন দুই তিনটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হতো। এখন কয়েকদিন পরপর একটা অর্ডার আসে। অগে আমার প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৪০০ মুরগি দরকার হতো। এখন অর্ডার না থাকায় মুরগি কেনা হয় অনেক কম। রাতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য মুরগি কিনতে এসেছি। ১১৫ টাকা দরে একশ পিস মুরগি নিয়েছি। অবশ্য মুরগি বেশি নিতে পারলে দামটা আরও একটু কমে পেতাম। তবে হরতাল-অবরোধের আগে আমরাই এদের কাছ থেকে ১৪০-১৪৫ টাকা পাইকারি দরে মুরগি ক্রয় করতাম।
 
এ মুহূর্তে পোল্ট্রি খামারি, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী, ক্রেতারা অবরোধ-হরতাল বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তা না হলে কিছু দিনের মধ্যে এ খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। এর সাথে সারাদেশে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। অন্তত সাধারণ মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেশের দুই রাজনৈতিক দল দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।