গাজীপুর, কাপাসিয়া পোল্ট্রি খামার থেকে ফিরে: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালের কবলে পড়ে কাপাসিয়ার পোল্ট্রি শিল্প এখন ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে পরিবহন খরচ বেড়েছে, ৫০ কেজি ওজনের ব্রয়লারের খাদ্য বস্তাপ্রতি ১০০টাকা বেড়ে হয়েছে ২২’শ টাকা।
এছাড়াও ডিমের দাম কমে যাওয়ায় এবং মুরগির খাবারের দাম বাড়ায় অনেক খামারি ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সব থেকে বড় কথা এখন তাদের প্রতি কেজি ব্রয়লার পাইকারিতে ১০৩ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে; এতে করে প্রতি হাজার ব্রয়লারে গড়ে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
কাপাসিয়ার বরুণ গ্রামের ব্রয়লার খামারি ফজলুল হক। প্রায় ২২ বছর তিনি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু চলমান হরতাল অবরোধের ক্ষয়ক্ষতির মতো ক্ষতির মুখে এর আগে কখনো পড়েননি। হরতাল অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে এই আশা করতে গিয়ে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান তিনি।
ব্রয়লার খামারী ফজলুল হক বাংলানিউজকে বলেন, হরতাল ছাড়বে আশা করতে গিয়ে খালি লসের পর লস। খাদ্যের দাম বাড়তি, সে তুলনায় মুরগির দাম অনেক কম। ব্রয়লারে বাচ্চা ওঠাতে ডর (ভয়)করে। গেল চালানে এক হাজার মুরগিতে ১৮ হাজার টাকা পুঞ্জিসহ(পুঁজিসহ) ক্ষতি। ’
তিনি আরও বলেন, এখন নাকি আগের মতো ঢাকা শহরে অনুষ্ঠান হয় না। গাড়ি খরচা বেশি। ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে ব্রয়লার বিক্রি করতে পারলে এক হাজার মুরগিতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হতো। কিন্তু ১০৩ টাকা দরে মুরগি বিক্রি করার কারণে উল্টা ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি। ’
ব্রয়রার বাচ্চা কেনার ৩০ থেকে ৩২ দিনের মধ্যে বিক্রি করতে হয়। প্রথম কিছু দিন ব্রয়ালার বাচ্চা কম খাবার খায়। তবে বাচ্চার বয়স ২০ দিন অতিবাহিত হলে এক হাজার বাচ্চা গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে চার বস্তা খাবার খায়। বাচ্চার বয়স ৩২ দিন অতিবাহিত হলে খাবার বেশি খায় কিন্তু সে তুলনায় ওজন বাড়ে না। তাই দাম যা-ই হোক ব্রয়লার বিক্রি করে দিতে হয় খামারিদের।
৩০-৩২ দিন পরে ইচ্ছা করলেও খামারিরা ব্রয়লার খামারে আর রাখতে পারেন না। হরতালের সব খামারির মাথায় হাত। পাশের কান্দাইনা গ্রামের খামারি কালাম। তিনিও ক্ষয়ক্ষতি ও লোকসানের শিকার। তিনি ভয়ে খামারে ছোট বাচ্চা তোলেননি। এখন আপাতত খামার বন্ধ রেখেছেন।
কালাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাচ্চা উঠাইতে ডর করে। ব্রয়ালের দাম কম কিন্তু কমে না বাচ্চার দাম। খামারের খরচও আগের চেয়ে বেশি। হয় সরকার হরতাল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিক, না হয় ব্রয়লারের খাবারের দাম কমাক। দ্যাশের পরিস্থিতি ভালো না হইলে বাচ্চা উঠামু না। পরে যদি জমি রিহান দিয়া ভরুণ লাগে(ক্ষতি পোষানো)।
শুধু ব্রয়লার খামার নয়, উৎপাদিত ডিমের দাম পড়ে যাওয়াতে বিপাকে পড়েছে অনেক খামারি। ডিম উত্পাদনকারী(লেয়ার)খামারিদের অনেকেই এরই মধ্যে পথে বসেছেন। রাজনীতির আকাশে কোনো আশার আলো না দেখায় এরই মধ্যে অনেকে ডিমপাড়া লেয়ার বিক্রি শুরু করে দিয়েছেন।
ব্রয়লার মুরগির থেকে লেয়ার মুরগির খরচা একটু বেশি। প্রতিটি ডিমপাড়া লেয়ার মুরগির বাচ্চার দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা।
অপরদিকে ওষুধ খরচা বেশি পড়ে। কারণ ব্রয়লারের থেকে লেয়ারের প্রতি বেশি যত্নবান হতে হয়। ৪২ টাকা দিয়ে লেয়ারের বাচ্চা কেনার ১৮ মাস বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। রোগের ভয়ে খামারিরা নিয়মিত রেনামাইসিন ও হেপাটনিক ওষুধ খাওয়ায়।
প্রতি কেজি রেনামাইসিন ৭৪০ ও হেপাটনিক ৪৬০ টাকা দরে কেনা লাগে। অপরদিকে একশ ডিম মাত্র ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়। এক সময় যা ছিল ৮০০ টাকা।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে প্রতিহাজার লেয়ার মুরগিতে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচার পরেই কেবল এরা ডিম পাড়া শুরু করে। কিন্তু ডিমের দাম পড়ে যাওয়া এবং খাদ্যের বাড়তি দামের কারণে অনেকে ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি শুরু করেছে। তাদেরই একজন কাপাসিয়ার লেয়ার খামারি জালাল কাজী।
তিনি বলেন, এই সময় ১০০ ডিমের দাম থাকতো ৮০০ টাকা, অনে(বর্তমানে) ৬৫০ টাকা। আগে ডিমের দাম ভাল আচিন(ছিল), খাদ্যের দাম কম আচিন। অনে সব কিছুর দাম বাড়তি। এতো খরচা দেওয়ার পরও ডিমের যে দাম পাওয়া যায় তা দিয়ে আমাদের কুলায় না। তাই সরাসরি ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে খামার সাফা (খালি) করছি। ’
হাজার মুরগির জন্য শ্রমিক খরচা সাত হাজার টাকা, বিদ্যুৎ খরচা তিন হাজার টাকা লাগে। অপরদিকে প্রতিমাসে প্রায় দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে।
অনেক ঘাম, শ্রম ও অর্থব্যয় করার পরেই লেয়ার মুরগি ডিম পাড়া শুরু করে। কিন্তু হরতাল ও অবরোধে ডিমের দাম পড়ে যাওয়ায় অনেক খামারির মাথা হাত। বছর দেড়েক আগে খামার দিয়ে ছিলেন জয়নাল শেখ। তিনি তার তিন তলা লেয়ার খামারটির নাম দিয়েছেন স্ত্রী ফরিদার নামে ‘ফরিদা পোল্ট্রি কমপ্লেক্স’। তিন হাজার লেয়ারে প্রায় ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচা করেছেন তিনি। টাকা ব্যয় করার পালা শেষ এখন শুধু আয় করার পালা। কিন্তু হরতালে ডিমের দাম পড়ে যাওয়া মাথায় হাত জয়নালের।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ডিমের দাম কম। এখন বাধ্য হয়ে ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে দিতে হবে। আর তাতে যদি না পোষায় তাহলে এক সময় হয়তো খামার ও ভিটা বিক্রি করে পথে বসতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫
** বিকিকিনি-সরবরাহ অর্ধেকে, নেই কর্মচাঞ্চল্য