শেরপুর (বগুড়া): দই ও মিষ্টান্ন সামগ্রীকে কেন্দ্র করে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার পৌরশহর এলাকায় প্রায় দেড় শতাব্দি আগে গড়ে ওঠেছে ঐতিহ্যবাহী দুধের বাজার। ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল ও টানা অবরোধের কারণে সে ঐতিহ্য যেনো হারাতে বসেছে।
উৎপাদিত দুধ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করতে বেগ পেতে হচ্ছে খামারিদের। ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দুধের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতি লিটার দুধ ৬০-৭০ টাকার স্থলে ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম পড়ে যাওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতা সংকটে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এই বাজারটি।
পৌর শহরের সকাল বাজার ও রেজিস্ট্রি অফিস এলাকায় বহু বছর ধরে নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এই দু’টি বিশাল দুধের বাজার বসে। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে কেবল এ দু’টি বাজারেই প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ মণ দুধ আমদানি হয়।
এছাড়া উপজেলার সীমাবাড়ী, মির্জাপুর, রানীরহাট, ছোনকা, ভবানীপুর, জামাইল, দোয়ালসাড়াসহ অন্তত আরও ২৫-৩০টি এলাকায় প্রতিনিয়ত ছোটখাটো দুধের বাজার বসে। এসব বাজারেও বিপুল পরিমাণ দুধের আমদানি হয়।
কিন্তু হরতাল আর টানা অবরোধের কারণে এসব বাজারে দুধের আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। কেবল পৌর শহরের এই দুইটি বাজারে আমদানি কমতে কমতে ২০০-২৫০ মণের স্থলে ১০০-১৫০ মণে নেমে এসেছে। একই চিত্র উপজেলার অন্যান্য দুধ বাজারেরও।
সবমিলে অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে ঐতিহ্যবাহী এ দু’টি বাজারসহ অন্যান্য বাজার থেকে ক্রেতা কমে যাওয়ায় দুধের বাজার দরে অস্বাভাবিক ধস নেমেছে।
শেরপুরের ইতিহাস- গ্রন্থের লেখক ইতিহাসবিদ প্রাক্তন অধ্যক্ষ রোস্তম আলী, ভূষণ ঘোষ, গোপাল ঘোষ, মৃত গোপেশ্বর ঘোষের ছেলে নিমাই ঘোষসহ একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, প্রায় দুই শতাব্দি আগে পৌর শহরের ঘোষপাড়ার ঘোষ পরিবারের লোকজন দই তৈরির কাজ শুরু করেন। দুধের চাহিদা মেটাতে সে সময় তারা নিজেরাই গাভী পালন করতেন। আর সেই দুই ব্যবসাকে ঘিরে সেখানে দুধের বাজার বসতে শুরু করে।
তারা আরো জানান, প্রায় দেড় শতাব্দি ধরে এখনো সকাল বাজার এলাকায় দুধের বাজার বসে আসছে। তবে ২০-২২ বছর আগে বাজার বসা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হলে শহরের রেজিস্ট্রি অফিস এলাকায় আরেকটি দুধের বাজার গড়ে ওঠে।
গজারিয়া গ্রামের দুধ বিক্রেতা আবু হানিফ, উচরংয়ের আব্দুল বারি, মামুরশাহীর রেজাউল করিম, ভীমজানির সোহরাব হোসেন, চকমুকুন্দর হেলাল উদ্দিন, বোয়ালকান্দির আব্দুল জলিল, দশশিকাপাড়ার জেল হোসেন, উচরংয়ের শুকুর আলী বাংলানিউজকে জানান, নিজেদের খামার ও বিভিন্ন গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহ করেন। পরে সেই দুধ শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভটভটি, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান, সাইকেলে করে জারে নিয়ে আসেন তারা।
তারা জানানা, ঐতিহ্যবাহী এ দু’টি বাজারে দু’একজন ছাড়া প্রায় সবাই খাঁটি দুধ বিক্রি করে থাকেন। এছাড়া এখানে সব সময় উপজেলার অন্যান্য বাজারের তুলনায় লিটার প্রতি দুধের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি পাওয়া যায়।
কারণ হিসেবে তারা জানান, এ উপজেলায় ছোটবড় ৩৫/৪০টি হোটেল ছাড়াও পৌর শহরে ঘোষদের বড় বড় দই মিষ্টির দোকান রয়েছে। তাছাড়া শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী দইয়ের খ্যাতি দেশজুড়ে। অপরদিকে, প্রতিদিন চা তৈরির জন্য প্রায় ৫০/৬০ মণ দুধ প্রয়োজন হয়।
কিন্তু টানা অবরোধ আর হরতাল সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথম ১৫ দিন একটানা প্রতি লিটার দুধ ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করে হয়েছে। তবে গত দুই সপ্তাহ হলো দাম একটু বেড়েছে। তাও আবার মাঝে মধ্যেই ২০-২৫ টাকায় নেমে আসে।
দুধ বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য কেউ কেউ ৩৫ টাকা পর্যন্ত দুধ বিক্রি করেছেন। তবে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের দুধ বাজারের চিত্র আরও করুণ। সেখানে এখনও প্রতি লিটার দুধ ২০-২৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
বিক্রেতারা জানান, অবরোধ-হরতাল এভাবে চলতে থাকলে তাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের পথে বসতে হবে। কারণ এভাবে নিয়মিত কম দামে দুধ বিক্রি করে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। এর ওপর গাভীর খাবার কেনার টাকা আসবে কোথ থেকে -এমন প্রশ্ন সবার। সবমিলে দুধের বিক্রেতাদের এখন চরম দুর্দিন।
দই ব্যবসায়ী নিমাই ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, অবরোধ-হরতালের কারণে উৎপাদিত সব দই বাজারজাত করা যাচ্ছে না। তাই দই ও মিষ্টান্ন উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা কেবল ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দুধ কিনছেন। ফলে দুধের চাহিদাও কমে গেছে। এমনকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে দুধের দাম আরও কমে যাবে বলে এই ব্যবসায়ী মনে করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫