ঢাকা: বিমা গ্রাহক (পলিসি হোল্ডার) ও শেয়ার হোল্ডারদের অর্থ খরচের ক্ষেত্রে আইন মানছে না প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর মোটা অঙ্কের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করছে।
বাংলানিউজের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ৪টি বছরের অবৈধ ব্যয়ের তথ্য এসেছে। এরমধ্যে সর্বশেষ বছরে (২০১৪ সালে) আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে। এর আগের ৩ বছরে এ খাতে অবৈধভাবে ব্যয় করা হয়েছে আরও ৫৬ কোটি টাকা।
পলিসি হোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ অবৈধভাবে ব্যয় করার কারণে গত বছর প্রাইম ইসলামী লাইফে নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
প্রাইম লাইফের তৈরি করা ২০১৪ সালের হিসাব বিবরণী (প্রভিশনাল) অনুযায়ী, বছর শেষে নতুন ব্যবসা (প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়) হয়েছে ৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর নবায়ন ব্যবসা হয়েছে ১৬৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ আয়ের বিপরীতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ সর্বোচ্চ খরচ করা যায় ৭১ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এরমধ্যে প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয় থেকে ৫৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয় থেকে ১৬ কোটি ৫২ লাখ ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা যাবে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ খরচ দেখিয়েছে ৮২ কোটি এক লাখ ৪৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার টাকা। যা ১৯৫৮ সালের বিমা বিধির ৩৯ ধারার লঙ্ঘন।
প্রতিষ্ঠানটির ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালের তথ্য পর্যালোচনা করেও আইন লঙ্ঘনের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে প্রাইম ইসলামী লাইফ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করে ২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বছরটিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৫৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় করা হয় ৮৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
আর ২০১২ সালে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৬৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অথচ ব্যয় করা হয় ৮৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ অবৈধভাবে ব্যয় করা হয় ১৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০১১ সালে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখানো হয় ৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
অর্থাৎ শেষ চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ৬৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ টাকার ৯০ শতাংশই বা ৫৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা পলিসিহোল্ডারদের পাওয়ার কথা। বাকি ৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা শেয়ারহোল্ডারদের।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে কোন কথা বলতে চাননি প্রতিষ্ঠানটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মোরতুজা আলী।
প্রাইম লাইফের তৈরি করা হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে নতুন ব্যবসা সংগ্রহ করতে এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্টদের কমিশন দেওয়া হয়েছে ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এরমধ্যে ১২ হাজার ৫১০ জন এজেন্টকে দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। আর ১০ হাজার ৯২৯ জন এমপ্লয়ার অব এজেন্টকে দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ খরচ করেছে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। নবায়ন ব্যবসার জন্য এজেন্টদের কমিশন দিয়েছে ৬ কোটি ৬৮ লাখ এক হাজার টাকা।
এছাড়া ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অংশ হিসেবে বাড়ি ভাড়া বাবদ খরচ করা হয়েছে ৬ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। আর অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খরচ দেখা হয়েছে ২৬ কোটি ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
এদিকে সরকারিখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করছে প্রাইম ইসলামী লাইফ। আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে কমপক্ষে ৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা বিনিয়োগ থাকার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ খাতে বিনিয়োগ করেছে মাত্র ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা ১৯৩৮ সালের বিমা আইন লঙ্ঘন।
এ আইনের মাধ্যমেই জীবন বিমা কোম্পানির বিনিয়োগের নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইনে জীবন বিমা কোম্পানিকে সরকারি বন্ডে গ্রহীতার অংশের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাকি ৭০ শতাংশ অন্যান্য ঝুঁকিমুক্ত খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বরেন, আমরা আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখবো। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় তবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোম্পানিটিতে গত বছর নিরীক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা কেন হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫