ঢাকা: ‘৭ বিলিয়ন ডলার’ অর্থের অনুসন্ধান করতে গিয়ে মুসা বিন শমসেরের আরো ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্প্রতি আলোচিত এই ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থার কাছে নিজেই সুইস ব্যাংকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এই ৫ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
দুদককে মুসা বিন শমসের জানিয়েছেন, সুইস ব্যাংকে তার কেবল একটিমাত্র অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে এ অ্যাকাউন্টে সাত বিলিয়ন নয়, বর্তমানে মোট জমা ১২ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৩ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) সমপরিমাণ।
এ অর্থ জব্দ অবস্থায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
মুসার দেওয়া নতুন এ তথ্যের পর আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অর্থের পরিমাণ ও উৎস জানতে সুইস ব্যাংকে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে দুদক।
বৈধভাবেই এ অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা হয়েছে দাবি করে দুদককে মুসা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে তার কোনো অর্থই সুইস ব্যাংকে জমা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, এর আগে দুদক জানতো, সুইস ব্যাংকে মুসার জব্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ অর্থ রয়েছে ধরেই অনুসন্ধান চালাচ্ছিলো দুদক। কিন্তু ১২ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা স্বীকারের পর স্বভাবতই দুদক মুসার কাছে বিশাল এ অংকের অর্থের বিষয়ে জানতে চায়।
জবাবে মুসা দুদককে জানান, বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে তার একাউন্টে এ অর্থ জমা হয়েছে।
তবে জব্দ হওয়া এ অর্থ ফেরত পেতে আইনি চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানান মুসা বিন শসমের।
জাঁকজমকপূর্ণ চালচলনের জন্য বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে মুসা বিন শসমের ‘প্রিন্স মুসা’ হিসেবে পরিচিত। তবে তার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে আনে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের গতবছরের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের সেরা দশজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর মধ্যে তিনি অন্যতম।
সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধান টিম মুসার মালিকানাধীন বনানীস্থ জনশক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ড্যাটকো’ এবং তার গুলশানের বাসায় পরিদর্শনে যান। মুসাও সেসময়ে উপস্থিত ছিলেন।
এসময় দুদকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুইস ব্যাংকে নতুন ৫ বিলিয়ন ডলারের তথ্য দিয়ে বলেন, ব্যাংকটিতে জব্দ থাকা মোট অর্থের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে গতবছর সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৭ বিলিয়ন ডলার রয়েছে বলে বিশেষ সূত্র থেকে জানতে পারে দুদক। ওই অর্থ অবৈধপন্থায় বিদেশে পাচার করা হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখতে গত নভেম্বরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়।
দুদকের উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদিন শিবলী ওই সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এটা অনুসন্ধানাধীন। চলমান অনুসন্ধানের বিষয়ে এখনই কোনো তথ্য প্রকাশ করতে চাই না। ’
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বাংলানিউজ থেকে মুসা বিন শমসেরের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হয়। এ নিয়ে তার ড্যাটকো অফিসে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক এটিএম মাহবুব মোরশেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্যার (মুসা) এসব বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলবেন না। কোনো প্রশ্ন থাকলে স্যারকে মেইল করতে পারেন। ’
এরপর মুসার সঙ্গে তার ইমেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে এতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ফের মাহবুব মোরশেদের শরনাপন্ন হলে তিনি বলেন, সুবিধাজনক সময়ে প্রয়োজন হলে উনিই (মুসা) যোগাযোগ করবেন।
দুদককে নতুন যেসব তথ্য দিয়েছেন মুসা
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মূসা বিন শমশের সম্প্রতি দুদককে জানিয়েছেন- ৪২ বছর বিদেশে বৈধভাবে ব্যবসার মাধ্যমেই তিনি ১২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন, যা সুইস ব্যাংকে তার নিজস্ব একাউন্টে জমা হয়েছে। তার একাউন্টে প্রত্যেকটি ইনকামিং রেমিটেন্স বা মানি ট্রান্সফার হয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে। সৌদি-আরব, কুয়েত, ইরাক, মিসর, সিরিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশের সরকারি প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত পাওনা পরিশোধের বিপরীতে এসব অর্থ ব্যাংকটিতে জমা হয়েছে বলে দুদকের কাছে দাবি করেন তিনি।
দুদকের জেরায় তিনি আরও দাবি করেন, সুইস ব্যাংকে তার একটি মাত্র একাউন্ট এবং ওই একাউন্টে শুধু বাংলাদেশেই নয়, কোন দেশ থেকেই সন্দেহজনক মানি ট্রান্সফারের ঘটনা ঘটেনি।
সাভারে ১২শ বিঘা জমি!
‘আরো ৫ বিলিয়ন ডলার’ সুইস ব্যাংকে থাকার নতুন তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তার বেশকিছু সম্পদের হিসাবও দিয়েছেন মুসা।
দুদককে তিনি জানিয়েছেন, সত্তরের দশকে তার নামে ঢাকা জেলার সাভার অঞ্চলে বিভিন্ন দাগে বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন দলিল ও সাফ-কবলার মাধ্যমে প্রায় ১২শ’ বিঘা জমি তিনি খরিদ করেছেন। তার অধিকাংশ জমি বর্তমানে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন মৌজায় তফসিলভুক্ত। অধিকাংশ সময় দেশে না থাকায় এসব জমির খাজনা পরিশোধ করে নামজারি করা সম্ভব হয়নি। তবে গত কয়েক বছরে দেশের অবস্থানের কারণে জমিগুলো পুনরুদ্ধারে নামজারি করে নিজের আয়ত্বে আনায় চেষ্টা করছেন।
১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের এই ব্যবসায়ী।
সুইস ব্যাংকে ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থের অনুসন্ধানে গতবছরের নভেম্বরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ১৮ ডিসেম্বর দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। চার নারী নিরাপত্তাকর্মীসহ ৪০ জনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বহর নিয়ে তিনি সেদিন রাজকীয় কায়দায় দুদকে প্রবেশ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সুইস ব্যাংকে জব্দকৃত অর্থ অবমুক্ত হলে এসব অর্থ পদ্মাসেতু নির্মাণসহ মানবকল্যাণে ব্যয় করবেন।
১৯৪৫ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম নেয়া মুসা ‘ড্যাটকো’র মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। তার এ প্রতিষ্ঠানটি গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।
এ প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মুসা বিন শমসের পুরোপুরি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছেন। গত কয়েকবছর ধরে টানা বিদেশে অবস্থান করলেও বর্তমানে দেশে তার বনানীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘ড্যাটকো’ এবং রাজধানীর গুলশানের ৮৪ নম্বর রোডে ‘দ্য প্যালেস’ নামে ১৫ নম্বর বাড়িটিতে কাটছে মুসা বিন শমসেরের সময়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫