ঢাকা: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা হরতাল-অবরোধ একে একে পার হলো তিন তিনটি মাস। এই তিন মাসের সহিংসতাতেই অর্থনীতির সব খাতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।
আর্থিক খাত, রাজস্ব আদায় খাত, রপ্তানি-আয়ের খাত, শেয়ারবাজারেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ধরে রাখা যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সময়ে দেশের অর্থনীতি সোনালী সময় পার করছিলো ঠিক সে সময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। রাজনৈতিক সহিংসতা এগিয়ে চলা অর্থনীতিকে হঠাৎ থমকে দিয়েছে। অস্থিরতার প্রথম দুই মাসেই অর্থনীতিতে শত কোটি টাকার উপরে ক্ষতি হয়ে গেছে।
তবে গত এক মাস ধরে রাজনৈতিক সহিংসতা অনেকটা কমে এসেছে। গতি ফিরে পেয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে বছরের প্রথম দুই মাসে অর্থনীতিতে যে হারে ক্ষতি হচ্ছিলো তা অনেকটা কমে এসেছে। ব্যবসায়ীরাও ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে উঠছেন। পরিস্থিতি আবার অস্থিতিশীল না হলে ঘটে যাওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন ব্যবাসয়ীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএ’র সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বছরের শুরুর দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হচ্ছিলো তা আর এখন হচ্ছে না। তবে এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের পথে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে। পরিস্থিতি আবার যদি অস্থিতিশীল না হয়, তাহলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। গত তিন মাসে শতাধিক ট্রাকচালক ও সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। এটি খুবই অমানবিক। অথচ এ সময়ে একজনও রাজনৈতিক কর্মী মরেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের মতে, অর্থনীতি যে সময়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি বন্ধ হওয়া উচিত। অর্থনীতিকে ধ্বংস করে কোনো রাজনীতি হতে পারে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতের মতে, দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তা সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সে অগ্রযাত্রায় কিছুটা ভাটা পড়েছে।
তার মতে, টানা হরতাল-অবরোধে সরবরাহ চেইন ভেঙ্গে পড়ে। ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে ব্যাংকসহ সার্বিক আর্থিক খাত ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে অর্থনীতিরি ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
মূল্যস্ফীতি: ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা মূল্যস্ফীতির উপর রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের তথ্যকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের শুরুতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) মূল্যস্ফীতি ছিলো ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশে।
এরপর নভেম্বর শেষ তা কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২১ শতাংশে, ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১১ শতাংশে। চলতি বছরের প্রথম মাস (জানুয়ারি) শেষে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক শুন্য ৪ শতাংশে।
তবে ফেব্রুয়ারি মাসে এসেই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা মূল্যস্ফীতির ধারা থমকে গেছে। ফেব্রুয়ারি শেষে মূল্যস্ফিতি আগের মাসের তুলনায় দশমিক ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশে। মার্চ শেষে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়েছে। তবে মার্চ শেষে মূল্যস্ফীতির হার কতো দাঁড়িয়েছে তা সঠিক জানা যায়নি।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি: রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে দেশি-বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগেই কমেছে আশংকাজনক হারে। জানুয়ারিতে মাত্র একটি সরাসরি বিদেশি বনিয়োগের (এফডিআই) প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কোনো এফডিআই নিবন্ধিত হয়নি বলে জানা গেছে।
অপরদিকে দেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ১২টি।
অথচ বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের একই সময়ে শতাধিক প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছিল। এমনকি বছরটির শেষ তিন মাসেই (অক্টোবর-ডিসেম্বর) নিবন্ধিত হয়েছিল ২৯১টি প্রস্তাব।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যে অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে শতভাগ বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১২টি এবং যৌথ বিনিয়োগের জন্য ১৫টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখায়। টাকার অঙ্কে এ বিনিয়োগের পরিমাণ এক হাজার ৭১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
আগের তিন মাসে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন ---এই সময়ে ২৬টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১০টি এবং যৌথ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ১৬টি।
আর্থিক খাত: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিলো পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিলো ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিলো চার লাখ ৯৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। আর শ্রেণিকৃত ঋণ ছিলো ৫৭ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শ্রেণিকৃত ঋণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ১ দশমিক ৯১ শতাংশ কমে যায়।
তৃতীয় প্রান্তিক শেষ শ্রেণিকৃত ঋণের হিসাব এখনো বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করেনি। তবে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা।
ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণের ক্ষেত্রে দু:সংবাদ থাকলেও কিছুটা আশার আলো জাগিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ১ এপ্রিলের হিসাব অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৩ দশমিক ৯১ মিলিয়ন ইউএস ডলার। যা ২০১৪ সালের একই সময়ে ছিলো ১৯ হাজার ৩৭৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
রাজস্ব খাত: ভালো অবস্থানে নেই রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাকি চার মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রাজস্ব আদায় করতে হবে ৭০ হাজার কোটি টাকার উপরে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই থেকে অক্টোবর –এই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে আদায় হয়েছে ৪২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
রফতানি আয়: তাজরীনে আগুন, রানা প্লাজা ধস, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানার আগুনের ঘটনায় পোশাক খাতে রফতানি আয়ে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। গত অর্থবছর (২০১৩-১৪) শেষে দেশে প্রথমবারের মতো তিন হাজার কোটি ডলার রফতানি আয় হয়।
চলতি অর্থবছরে নভেম্বর শেষে রফতানি আয় দাঁড়ায় এক হাজার ৭ কোটি ডলারে। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩১১ মিলিয়ন ইউএস ডলার। তবে রজনৈতিক অস্থিরতা ও ইউরোর দাম কমায় চলতি অর্থবছর শেষে রফতানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ইউরোর দাম কমেছে ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
শেয়ারবাজার: একে একে ৪টি বছর পার হয়ে গেলেও ২০১০ সলে ঘটে যাওয়া মহাধসের রেশ কাটেনি। এর অভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি দেশের শেয়ারবাজার। আগের চার বছরের মতো চলতি বছরেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে এই বাজার। ২০১৪ সালের শেষ সময়ে এসে নভেম্বর থেকে কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস দিলেও, চলতি বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় তা আবার পথ হারিয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের অধিকাংশ দিনই শেয়ারবাজারে মূল্যপতন ঘটেছে। বছরের প্রথম দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিলো ৪ হাজার ৯৪১ পয়েন্টে। যা ২ এপ্রিলের লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭২ পয়েন্টে। অর্থাৎ তিন মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৪৬৯ পয়েন্ট।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি: সব দিক বিবেচনায় চলতি অর্থবছর (২০১৪-১৫) কাঙ্ক্ষিত মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে কিনা- তা একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকবে। অর্থবছরটির বাজেটে ডিজিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ৩৪ থেকে ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপির ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে। সুতরাং অর্থবছর শেষে এ হার ৩৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলেই ধরে নেওয়া যায়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আইএমএফ বলছে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ থেকে ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
আর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে থাকবে। অথচ জানুয়ারির রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর আগে গভর্নর একাধিক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের উপরে থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্ট, এপ্রিল ০৮, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম