বগুড়া: পুঁজির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বেড়েই চলছে।
জেলার শিল্পনগরীর জাহেদ মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ পরিদর্শন ও অনুসন্ধানে জানা যায়, নানামুখী সংকটের কারণে দফায় দফায় প্রতিষ্ঠানটির ফাউন্ড্রি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৌশল শিল্প ইউনিটগুলো অনিয়মিতভাবে কোনোরকম চালু রাখা হয়েছে। এখন ফাউন্ড্রিসহ চালু রয়েছে মাত্র তিনটি ইউনিট। এ তিন ইউনিটে সীমিত আকারে উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে বিখ্যাত ঘোড়া মার্কা কোদাল, কড়াই, জালকাঠি, তাওয়া, বাটখাড়া, টিউবওয়েল, রাইস মিলের চাল বাছাই নেটসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রাংশ।
এমন খুঁড়িয়ে চললেও শিল্প প্রতিষ্ঠানটিই বগুড়া শিল্প নগরীর অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
১৯৫৫ সালে শিল্পপতি এম জাহেদ আলী বগুড়া শহরের কাটনার পাড়ায় নিজ বাড়িতে ঢালাই কারখানা (ফাউন্ড্রি) চালু করেন। সেখানে বাটখারা, জালকাঠি, নানা মাপের কড়াই, কাস্ট আয়রনের তৈজষপত্র তৈরি হতো। অল্প সময়ের মধ্যেই এ ইন্ডাস্ট্রিজে উৎপাদিত পণ্যের সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে উৎপাদন বাড়াতে কারখানাও সম্প্রসারণ করতে হয়।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আবাসিক এলাকা। পরে আবাসিক এলাকা দূষণমুক্ত রাখতে ১৯৬২ সালে জাহেদ মেটাল কামারগাড়িতে ৯ একর জমির ওপর স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৪ সালে এতে যুক্ত করা হয় প্রকৌশল শিল্প।
তৎকালীন সরকার সারাদেশে মাত্র তিনটি ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। তার মধ্যে জহেদ মেটাল একটি।
জাহেদ মেটালে নতুন করে যুক্ত প্রকৌশল শিল্প চালু করতে সেসময় জার্মানি থেকে মূল্যবান প্রেস ও রোলিং মেশিন আমদানি করা হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার অবস্থা ছিল রমরমা।
ফাউন্ড্রিতে রাইস মিলের যাবতীয় যন্ত্রাংশ, টিউবওয়েল, বাটখারা, কড়াই আর প্রকৌশল শিল্পে কোদাল, বেলচা, মিলের জালি উৎপাদন হতো সেসময়।
জ্বালানি হিসেবে ফাউন্ড্রিতে হার্ডকোক (খনিজ কয়লা) এবং প্রকৌশল কারখানায় ফার্নেস ওয়েল ব্যবহার করা হতো। ফাউন্ড্রিতে দিনে তিন টন লোহা গলিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি হতো। তিন শিফটে এখানে প্রায় আড়াই থেকে তিনশ’ শ্রমিক কাজ করতেন। সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে লাভজনক ফাউন্ড্রি শিল্পই পড়ে নানা বাধায়।
এসব বিষয়ে বাংলানিউজের আলাপ হয় জাহেদ মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক জায়নুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে তাদের বাজার ভারতীয় পণ্য দখল করে নিয়েছে। এছাড়া, অতিরিক্ত দামে জ্বালানি সংগ্রহের পাশাপাশি কাঁচামালের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সে কারণে অব্যাহতভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকায় লোকসানের বোঝা সইতে না পেরে ১৯৯০ সালে ফাউন্ড্রি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়।
জয়নুল বলছিলেন, ২০০৬ সালের কথা। তখন ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক অ্যাগ্রিকালচার ইমপ্লিমেন্ট ও এমআইএসসি ইউনিট চালু ছিল। ওই দু’টি ইউনিটে কৃষি যন্ত্রাংশ ও রাইস মিলের যন্ত্রপাতি উৎপাদন হতো। নিয়মিত ৫০ শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু সাড়ে তিন টাকার ফার্নেস ওয়েল তখন ১৪ টাকায় কিনতে হতো। সংকটের কারণে তা-ও চাহিদামতো পাওয়া যেত না। কাঁচামালের দামও ছিল অত্যন্ত বেশি। প্রতিমাসে ১৬ হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েলের চাহিদা থাকলেও মাত্র আট হাজার লিটার সরবরাহ করা হচ্ছিল। সেসব কারণে কয়েক দফায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হতে হয়।
জাহেদ মেটালের এ কর্মকর্তা বলছেন, চীন ও ভারত থেকে কোদাল, বেলচা ও রাইস মিলের যন্ত্রাংশ অবাধে আমদানি করা হচ্ছে। আর এর সঙ্গে জড়িত একশ্রেণির অসাধু আমদানিকারক ও চোরাকারবারী। কতিপয় অসৎ শুল্ক কর্মকর্তা-তাদের সহযোগিতা করেন।
জয়নুল জানান, বিদেশ থেকে আসা এসব পণ্যের মূল্য দেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও কম। ফলে দেশি পণ্য গুণে-মানে ভালো হওয়ার পরও দামের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিপর্যয় নেমে আসবে।
জাহেদ মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, পুঁজির অভাবে তারা আপাতত পুরোদমে উৎপাদনে যাচ্ছেন না। সব ধরনের ধকল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে দেড় শতাধিক শ্রমিকের কারখানাটিতে অগ্রিম অর্ডারের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের মালামাল তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
এমবিএইচ/এইচএ