যশোর: বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পর্বন! ফলে বছরজুড়েই থাকে ফুলের চাহিদা। তবে ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনকে সামনে রেখে ফুলের বাজার ধরতে আগে ভাগেই প্রস্তুতি নেয় ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি এলাকার ফুল চাষিরা।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ফুলের বাজার ধরতে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়েছিল যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি এলাকার ফুল চাষিরা। কিন্তু বিধি বাম, গত ১৫দিনের বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় ফুল গাছ উপড়ে ও পচন রোগে সব আশার গুড়ে বালি পড়েছে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, ঈদে খুব বেশি ফুলের চাহিদা থাকে না। তবে ঈদের ছুটিটে বিয়ের ধুম পড়ে। এতে ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে।
তিনি বলেন, বিশেষ দিন ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে স্থানীয় গদখালী ফুলহাটে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। কিন্তু গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ফুলগাছ নষ্ট হয়েছে। এছাড়াও কুঁড়ি ও ফুলের ভেতরে পানি ঢুকে অধিকাংশ ফুল পচে গেছে।
গদখালী ফুলহাটে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় ফুল চাষিরা অল্প-স্বল্প ফুল তুলে বিক্রির জন্য বাজারে এসেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুল পাঠাতে বেশ কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। তবে তাদের মুখে রয়েছে কষ্টের ছাপ।
স্থানীয় হাড়িয়া গ্রামের ফুলচাষী আব্দুল লতিফ, বিল্লাল হোসেন, বারিক, আজিজুর রহমান, আক্তার হোসেন, আব্দুস সাত্তারসহ অনেকেই বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টিতে ফুলের মধ্যে পানি ঢুকেছে, ফলে ঢাকায় নেওয়ার আগেই ফুল নষ্ট হবে- এ আশাঙ্কায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা ফুল কিনতে চাচ্ছেন না। তবে মঙ্গলবার প্রতি পিস গোলাপ ১ টাকা, গ্লাডিউলাস ৩ টাকা, জারবেরা ৮ টাকা, রজনীগন্ধা ৪ টাকা ও প্রতি হাজার গাঁধা ফুল ১০০টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় ফুলের আড়ৎ মালিক জালাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সারাবছর আশায় থাকলেও বৃষ্টির কারণে আমাদের আশার গুড়ে বালি পড়েছে।
ঝিকরগাছার সৈয়দপাড়া গ্রামের চান্দু মিয়া, সোহাগ এবং হাসেম আলীর গাঁধা ফুলের ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফুলগাছ বেঁকে-ঝেঁকে মাটিতে উপড়ে পড়েছে। গাছগুলোতে অসংখ্য ফুল থাকলেও অধিকাংশ ফুল ও পাতায় পচন ধরেছে। এ সময় হাসেম আলী ও চান্দু মিয়া বলেন, তারা ১৫ কাঠা করে গাঁধা ফুল চাষ করেছেন। তবে ফুল তুলে বাজারে নেওয়া শুরু করার আগেই বৃষ্টিতে সব গাছ নষ্ট হয়েছে। এখন ওই নষ্ট গাছ উপড়ে ফেলে তারা টমেটো চাষ করবেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি থেকে সারাদেশের মোট ফুলের চাহিদার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ফুল সরবরাহ করা হয়। প্রতিবছর বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সারাদেশে যে ফুল বিক্রি হয় তার ৭০ শতাংশ ফুল গদখালি থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
স্থানীয় কৃষকদের একমাত্র পেশা ফুল চাষ
১৯৯৫ সালের আগে এ অঞ্চলের যে কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন তারা পুরোপুরিই ফুল চাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অন্য ফসলের তুলনায় ফুল চাষ অধিক লাভবান হওয়ায় গদখালীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে অন্য কোনো ফসল চাষ করে না। ফুলচাষীরা জানান, অন্য ফসলের তুলনায় ফুলচাষে ১০ গুণ বেশি লাভ হয়। একবিঘা জমিতে ফুল চাষ করে খরচ ছাড়াও ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন চাষিরা।
স্থানীয় পুটপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বাংলানিউজকে জানান, প্রতি বিঘা জমিতে গোলাপ কিংবা গ্লাডিউলাস ফুলের চাষ করতে সবমিলিয়ে খরচ হয় ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা। এরপর চারা গাছে একবার ফুল ধরলে তা কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ফুল দেয়। এতে বছরে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা আয় আসে। যা অন্য ফসলের তুলনায় অধিক লাভজনক।
ফুল চাষি আবুল কাশেম জানান, বিঘাপ্রতি বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফুল চাষ শুরু করেন। এতে প্রতি বছরে তিনি কমপক্ষে ২ লাখ টাকা আয় করছেন।
সরকারি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ফুল চাষিরা
যশোরের গদখালী ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তেমন কোনো সহায়তা করেন না। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ফুল খেতে বিভিন্ন রোগ বালাই হলে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে কীটনাশক প্রয়োগ করেন।
অপরদিকে, স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের খেয়াল-খুশি মতো মাসে হয়তো একবার বেড়াতে আসেন।
স্থানীয় একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, কৃষকদের উৎপাদিত ফুল সংরক্ষণের জন্য একটি আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের জন্য তারা সরকারের কাছে দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া ফুল উৎপাদনের জন্য চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পায়না ফুল চাষিরা। তবে চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফুল সরবরাহের জন্য ট্রেনের একটি বগি বরাদ্ধ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীর।
ফুলের হাট গদখালী
স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গদখালীতে গড়ে উঠেছে বড় একটি ফুলের হাট। এ হাটে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা। প্রতিদিন রাত পোহাতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজির হয় ফুলের পাইকারি ক্রেতারা। এরপর তাদের চাহিদা অনুযায়ী ফুল কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যায় গন্তব্যে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
এসএইচ