ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী থাকার পর বিশ্ববাজারে গমের দাম এখন বাড়ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনে গমের উৎপাদন সংকটে পড়ায় বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টির পূর্বাভাস মিলছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা এগ্রি মানি বলছে, শিকাগোর বাজারে বিগত কয়েকদিন ধরে গমের দাম বাড়তির দিকে। এর প্রভাবে বাজারে গমের দাম চার শতাংশ বেড়েছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ গমই আমদানি করে মেটানো হয়। ফলে আর্ন্তজাতিক বাজারের ওপর দেশে গমের দাম পুরোটাই নির্ভরশীল।
দেশে উৎপাদিত গম দিয়ে দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ হয়, স্থানীয়ভাবে আবাদকৃত গমের উৎপাদন ব্যয়ও আমদানিকৃত গমের মূল্য অপেক্ষা বেশি। নতুন মৌসুমের দেশীয় গম বাজারে আসতেও প্রায় পাঁচ মাস বাকি। এই অবস্থায় আমদানি করা গমের মূল্য দেশীয় বাজারেও একধাপ বাড়তে পারে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যার প্রভাবে দেশে গম দিয়ে উৎপাদিত আটা-ময়দার দাম বেড়ে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে খাতুনগঞ্জের গমের পাইকারি আড়তদার অরুন সরকার বলেন, ‘বুধবার পাইকারি বাজারে ইউক্রেনের গম মণ প্রতি ৬৫০ টাকায়, কানাডার গম ৮৪০ টাকায় এবং ভারতের গম ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এসব গমের দাম একদিনেই মণপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। আর্ন্তজাতিক বাজারে চাঙ্গাভাব অব্যাহত থাকলে এর প্রভাবে দেশেও গমের দাম বেড়ে যাবে। আর স্বাভাবিকভাবেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গমের বাজারে। ’
শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) ডিসেম্বরে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি বুশেল গমের দাম দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে লেনদেন হয় ৫ ডলার ১০ সেন্টে। এর আগে সোমবার একই পরিমাণ শস্য ৫ ডলার ১২ সেন্টে বিক্রি হয়েছিলো, যা ছিল ১৫ অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ। গমের পাশাপাশি এদিন ভুট্টা চড়া দামে বিক্রি হলেও সামান্য কমেছে সয়াবিনের দাম।
সিবিওটিতে নভেম্বরে সরবরাহ চুক্তিতে বুশেলপ্রতি ভুট্টার দাম দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হয় ৩ ডলার ৮৪ সেন্টে। এদিন একই সময়ে সরবরাহের জন্য প্রতি বুশেল সয়াবিন লেনদেন হয় ৮ ডলার ৮৫ সেন্টে।
টোকিওর ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান ওকাতু সুজির কানেম গোকোন বলেন, শুষ্ক আবহাওয়ার পূর্বাভাস খুবই উদ্বেগজনক। বছরের শেষে সরবরাহের জন্য বর্তমানে প্রতি বুশেল গম গড়ে ৫ ডলার ১০ সেন্টে বিকিকিনি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমতল এলাকায় শুষ্ক আবহাওয়া অব্যাহত থাকলে চলতি সপ্তাহে দাম বেড়ে প্রতি বুশেলের মূল্য দাঁড়াতে পারে ৫ ডলার ২০ সেন্টে। এদিকে গমের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ভুট্টার বাজারেও। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়াতেও বৃষ্টিহীন আবহাওয়া বিরাজ করছে। তাই শস্যটির দরবৃদ্ধির পেছনে রাশিয়ার আবহাওয়া ভূমিকা রাখছে। কেননা শীর্ষসারির গম রফতানিকারক দেশের মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে।
কৃষি অর্থনীতি ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এগ্রি মানি বলছে, হ্যারিকেন প্যাট্রিসিয়ার কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব টেক্সাসে মুষলধারে বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু ওকলাহোমা ও শীর্ষ উৎপাদনকারী অঞ্চল কানসাসে এ সময় কোনো বৃষ্টি হয়নি। ফলে শুষ্ক আবহাওয়ার প্রভাব পড়ে শস্য আবাদে। এদিকে ইউক্রেনের আবহাওয়াও গম চাষের প্রতিকূলে থাকবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। গত সপ্তাহে দেশটিতে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে খরার কারণে দেশটিতে শস্যটির আবাদে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সে অনুযায়ী এ বৃষ্টি পর্যাপ্ত নয় বলে উদ্বেগে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইউক্রেনের কৃষি মন্ত্রণালয় বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার গম আবাদে জমির পরিমাণ ১০ শতাংশের মতো কমবে বলে জানিয়েছে।
বিশ্ববাজারে গমের দাম পর্যালোচনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে গমের দাম আগস্টে ছিল ৫০৭ ডলার, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ৩.৩ শতাংশ বেশি এবং গত বছরের এ সময়ের চেয়ে ১৫.৫ শতাংশ বেশি। বিশ্বে গম সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটি গমের বৈশ্বিক চাহিদার ২৭ শতাংশ মেটায়। এরপরে রয়েছে ইইউ (১৭ শতাংশ), অস্ট্রেলিয়া (১৪ শতাংশ) ও কানাডা (১৩ শতাংশ)। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শস্য উৎপাদনকারী কিছু অঞ্চলে বৈরী আবহাওয়ায় ফলন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এরই প্রভাবে বিগত দুই মাস থেকে গমের দামে চাঙ্গাভাব দেখা দেয়।
গত বছর ইউক্রেন সংকটের কারণে দেশেও গমের বাজার অস্থির হয়ে উঠে। সিংহভাগ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানি করায় দেশে গমের পাশাপাশি আটা-ময়দার দামও ওই সময় বেড়ে যায়। এর পর ব্যবসায়ীরা কানাডা ও ভারত থেকে শস্যটি আমদানি শুরু করলে দাম কিছুটা কমতে শুরু করে। তবে সম্প্রতি চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে পণ্যটির দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গম আমদানিতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যখন নির্ধারিত মান বজায় রেখে দেশে গম বাজারজাত করে আসছেন তখন কিছু ব্যবসায়ী নিম্নমানের গম আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করে অতি মুনাফা করছেন। এতে করে ভোক্তারা মানসম্মত পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
খাতুনগঞ্জের একজন গম ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রমজান ও ঈদে গমের চাহিদা বেড়ে যায়। তাছাড়া সরকারিভাবে আমদানি হওয়া পণ্যটির মান নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় বাণিজ্যিকভাবে আনা গমের চাহিদা বেড়েছে। ফলে এক সপ্তাহ ধরে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এ অবস্থায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অনেক অসাধু আমদানিকারক নিম্নমানের গমও আমদানি করছেন। এতে বৈধ ভাবে শুল্ক দিয়ে আমদানি করা ভালো মানের গম আমদানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে। ’
ঢাকার ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমের মোট উৎপাদন থেকে আটা ও ময়দার চাহিদার পরিমাণ বেশি হওয়ায় আসন্ন শীতকালে আটা ও ময়দার মূল্য বৃদ্ধি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কারওয়ান বাজারের আটা-ময়দা ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলী জানান, গমের দাম বাড়লেও আগের দরেই বিক্রি হচ্ছে আটা ও ময়দা। তাই দাম সমন্বয়ে আটা-ময়দার দামও বাড়তে পারে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, ‘গমের দাম বাড়ছে এটা ঠিক। অসাধু কিছু আমদানিকারক শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের গম আমদানি করছে। এসব গম থেকে নিম্নমানের আটা-ময়দা তৈরি করে তারা মানসম্মত পণ্যের আমদানিকারকদের বিপদে ফেলছে। ’
দেশে কনজ্যুমার পণ্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আটা-ময়দা উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করছে। এসব প্রতিষ্ঠানই নিম্নমানের গম কম মূল্যে কিনে নিয়ে আটা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, টিকে গ্রুপ, সজীব করপোরেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের গম সংগ্রহ করেছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য টিকে গ্রুপের পরিচালক তারেক আহমদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে কথা বলেননি। আগামীকাল (শুক্রবার) কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
আরআই