ঢাকা: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের কাছ থেকে মূসক বা ভ্যাট নিলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রযুক্তির ছোঁয়া কম থাকায় এতোদিন এ সমস্যার সমাধান দুরাশায় হয়নি।
বর্তমান যুগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সহজে এ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। ভুক্তভোগীদের অনেকে এ মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণার বিষয়টি এখন তুলেও ধরছেন। তাদের দেওয়া তথ্যমতে ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান চলছে।
অভিযানে অভিযোগের সত্যতা আর ভ্যাট ফাঁকির ভয়াবহ চিত্র পাচ্ছে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ। প্রতিরোধে গঠিত হয়েছে প্রিভেন্টিভ টিম, চলছে অভিযান।
এ ধরনের কয়েকটি অভিযোগ ও অভিযানের কেস স্টাডি নিম্নরুপ:
কেস স্টাডি-১
১০ অক্টোবর শনিবার। রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে খেতে গেলেন গুলশান-২ এর অভিজাত মেন্ডারিন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।
খাওয়া শেষে ৫৫৫ টাকা ভ্যাটসহ (১৫ শতাংশ) ৪ হাজার ৮২৫ টাকা ইসিআর (ইলেকট্রনিক্স ক্যাশ রেজিস্ট্রার) মেমো ধরিয়ে দিলেন বিক্রেতা। যদিও মেমোতে বিআইএন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) জায়গায় লেখা এএফআর (অ্যাপ্লাইড ফর রেজিস্ট্রেশন)। ক্যাশ মেমোসহ ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ফেসবুক পেজে অভিযোগ করলেন রবিউল ইসলাম। অভিযোগের পর জানা গেল প্রতিষ্ঠানটি বিআইএন নিতে ভ্যাট অফিসে আবেদনই করেনি।
কেস স্টাডি-২
দু’দিন পর সোহানা নামে এক নারী স্বামী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে একই রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন। এবার ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ৪ হাজার ৬২৫ টাকার ক্যাশ মেমো ধরিয়ে দিলেন বিক্রেতা। যদিও মেমোতে বিআইএন উল্লেখ নেই। ভ্যাট নম্বর নেই কেন ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করতেই ‘ভ্যাট নেই, সঠিকভাবে সরকারকে পৌঁছে দেয়’ কথা শুনিয়ে দিলেন।
তিনিও অভিযোগ করলেন ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে।
এভাবে অসংখ্য অভিযোগ আসতে থাকল ম্যান্ডারিনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগের সূত্র ধরে গত ২৮ অক্টোবর কাস্টমস প্রিভেন্টিভ টিমের আকস্মিক হানা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রেকর্ডপত্র জব্দ। মিলল অভিযোগের সত্যতা। শেষে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়ে রবিউলকে ফিরিয়ে দিলেন ২ হাজার ৭৫০ টাকা।
প্রিভেন্টিভ টিম রেকর্ডে দেখলেন গেল, ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিচ্ছেন কিন্তু ভ্যাট নিবন্ধন নেননি মালিকপক্ষ। সেটি নিতে কখনও ভ্যাট অফিসে যোগাযোগও করেননি তারা।
আরো দেখলেন, গত তিন মাসে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ভ্যাট গ্রাহকদের কাছ থেকে নিলেও জমা করেননি তারা। এ ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না রাখায় খেলেন মামলা।
কেস স্টাডি-৩
৯ নভেম্বর সোমবার। রাজধানীর পল্টন কড়াই গোশত রেস্টুরেন্ট। এখানকার বিক্রেতা ব্যবসা করছেন পল্টনের আর ক্যাশ মেমো দিচ্ছেন বসুন্ধরা রোড, বাড্ডার ঠিকানায়। একজন ভোক্তা মূসক গোয়েন্দার পেজে অভিযোগ করলেন। ওইদিনই রেস্ট্ররেন্টটিতে হানা দিলেন গোয়েন্দারা।
কম্পিউটার সিস্টেম, রেজিস্ট্রার, প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র জব্দ করা হল। তাতে গোয়েন্দারা দেখলেন, কড়াই গোশত মালিকের নিজ ঠিকানায় নেই ভ্যাট নিবন্ধন। যে নিবন্ধন ব্যবহার করছেন তা ভুয়া। ইসিআর আর মেমোতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করছেন। মাসে কয়েক লাখ টাকা ভ্যাট আদায় করলেও হিসেব ছাড়াই মাসে ৩০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করছেন।
কেস স্টাডি-৪
২৪ অক্টোবর শনিবার। একজন সহকারী কর কমিশনার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) গুলশান-১ এ স্ত্রী রাবিনার পছন্দের শর্মা হাউজে খেতে গেলেন। ওয়েটার ৭৮ টাকা ভ্যাটসহ (১৫ শতাংশ) ৫৯৯ টাকার বিল দিলে তিনি ১ হাজার টাকা দিলেন। বললেন, মূসক চালান দিতে হবে। কিন্তু মূসক চালান না দিয়েই বিল দিলেন বিক্রেতা। পরে সহকারী কর কমিশনার পরিচয় দেওয়ার পর ফেরত দিলেন ৭৮ টাকা। কিন্তু প্রতিদিন লাখ টাকা বিক্রি হলেও প্রতিষ্ঠানটির নেই বিআইএন। অনেক অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি মূসক গোয়েন্দারা শর্মা হাউজকে নজরদারিতে এনেছেন। পেয়েছেন ভ্যাট ফাঁকির নানা তথ্যও।
এভাবে প্রতিদিন ভ্যাট ফাঁকির অসংখ্য অভিযোগ করছেন ভোক্তারা।
সূত্র জানায়, ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট গত ফেব্রুয়ারিতে একটি ফেসবুক পেজ খোলে। মূলত মূসক বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরীর উদ্যোগে এ পেজ খোলা হয়। বর্তমানে তিনি মূসক, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফরে কর্মরত। এতে ভ্যাট বিষয়ক অভিযোগ আহ্বান করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া। বেশিরভাগ তরুণরাই এতে সাড়া দেন, দেন অভিযোগ। এরপরই মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরও পেজ খোলে। তাতেও ব্যাপক সাড়া। প্রতিদিন অভিযান, রহস্য উদঘাটন, মূসক আদায়, মামলা চলছে।
সর্বশেষ ১১ নভেম্বর পেজ ইনবক্সে ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গুলশানের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সি-শেল চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, সি-শেল রেসিডেন্টস, আনোয়ার মর্ডান হাসপাতাল ক্যান্টিনে অভিযান চালানো হয়। পাওয়া যায় অভিযোগের সত্যতা। এভাবে প্রতিদিন সারাদেশে অসংখ্য অভিযানে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। যদিও অর্থমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, দেশের ভ্যাট দেওয়ার উপযোগী ৪ লাখ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৬০ হাজার ভ্যাট দেয়। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশের পর এনবিআর ভ্যাটের আওতা বাড়াতে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে।
মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, সচেতনতা তৈরি করতে মূলত পেজ খুলেছি। তাতে প্রথম গুলশানের ইয়োলো সাবমেরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন ভোক্তারা। এরপর অভিযানে সত্যতা মিলল। সেই পোষ্ট পেজে দেওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেতে থাকি। প্রতিদিন ছবিসহ অন্তত শতাধিক অভিযোগ পাচ্ছি। অভিযানও চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠান সচেতন হয়েছে, দিচ্ছে নিয়মিত ভ্যাট। তবে জনবল, প্রযুক্তি থাকলে আরো বেশি কাজ করা যেত। বিআইএন ও ইসিআরের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ড সভায় তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ জারি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জনগণ উন্নয়নের জন্য নাগরিক দায়িত্ব থেকে ভ্যাট দিচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সে দায়িত্বের প্রতি সম্মান জানানো। জনগণের আস্থার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা ভ্যাট ফাঁকি রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, অভিযানের মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্য কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়, সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের সর্তক করা হচ্ছে। ভোক্তার কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিচ্ছেন না তাদের জন্য অশনি সংকেত। আমরা সৎ ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত ও সম্মান জানাতে চায়। ভ্যাট দেওয়ার উপযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান বাদ থাকবে না।
চেয়ারম্যান বলেন, আন্তর্জাতিক সমাজ মনে করে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় আরো বেশি হওয়া উচিত। রাজস্ব আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবেও এ অভিযান চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
আরইউ/এএসআর