ঢাকা: মিথ্যা জরিপ প্রতিবেদন দেওয়ায় সোনালী সার্ভেয়ারের নিবন্ধন সনদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিমা গ্রহীতা এসবি নিটওয়্যারের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে মিথ্যা প্রতিবেদন দেয় এ জরিপ প্রতিষ্ঠানটি।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহক এনবি নিটওয়্যারের কারখানায় ২০১২ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স সোনালী সার্ভেকে নিয়োগ দেয়। এতে জরিপ প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে মাত্র ২৩ হাজার টাকা।
এরপর কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের নিয়োগ দেওয়া জরিপ প্রতিষ্ঠান সোনালী সার্ভে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে বলে এসবি নিটওয়্যারের মালিক আব্দুর রহমান আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেন।
এ অভিযোগের ভিত্তিতে আবার জরিপের জন্য মেসার্স এশিয়ান সার্ভেয়ার্সকে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। এ প্রতিষ্ঠানটির জরিপে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
এরপর গত ২৬ অক্টোবর একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ডাকে আইডিআরএ। বৈঠকে এসবি নিটওয়্যারের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে সোনালী সার্ভের মিথ্যা জরিপ প্রতিবেদন দেওয়ার প্রমাণ পায় আইডিআরএ।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, মিথ্যা প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে জরিপ প্রতিষ্ঠান সোনালী সার্ভের নিবন্ধন সনদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে এসবি নিটওয়্যারের ১৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সোনালী সার্ভের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতিবেদন দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন আইন অনুযায়ী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মিথ্য প্রতিবেদন দেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে সোনালী সার্ভের প্রধান জরিপকারী হুমায়নের সঙ্গে মোবাইলে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আর কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মজুর নাদীম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুনেছি, আইডিআরএ এসবি নিটওয়্যারের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সোনালী সার্ভের দেওয়া জরিপ প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেনি। এজন্য আইডিআরএ’র এশিয়ান সার্ভেয়ার্সকে নিয়োগ দিয়েছে। তবে এ জরিপ প্রতিবেদন আমরা পাইনি।
তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, সোনালী সার্ভে ও এশিয়ান সার্ভেয়ার্সকে নিয়ে আইডিআরএ একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেছে। কিন্তু সোনালী সার্ভে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে এবং ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে আইডিআরএ থেকে আমরা কোনো চিঠি পাইনি। আইডিআরএ’র চিঠি পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। তবে আইডিআরএ আমাদেরকে দাবি পরিশোধের নির্দেশ দিতে পারে না। শুধু আগের জরিপ প্রতিবেদন মিথ্যা এ বিষয়ে অবহিত করতে পারে।
সোনালী সার্ভে মিথ্যা প্রতিবেদন দেওয়ার কারণ কি এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে ওই সময় আমি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে ছিলাম না। তাই কি কারণে সোনালী সার্ভে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে তা আমার জানা নেই।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স থেকে ২০১২ সালে দুটি বিমা পলিসি ক্রয় করে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য প্রতিষ্ঠান এসবি নিটওয়্যার।
মেয়াদ শেষে CIL/NGJ/FP – 0123/03/2014 এবং CIL/NGJ/FP-0194/04/2014 নম্বরের পলিসি দু’টি ২০১৪ সালের ৩ মার্চ ও ৩ এপ্রিল আবার নবায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর ওই বছরের ৬ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এসবি নিটওয়্যারের কারখানায়। এ অগ্নিকাণ্ডের বিমা দাবি নির্ণয় করতে জরিপ প্রতিষ্ঠান সোনালী সার্ভেকে নিয়োগ দেয় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স।
জরিপ শেষে সোনালী সার্ভে ক্ষতির পরিমাণ ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, কারখানাটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পর কারখানার ভেতরে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি পানি জমে ছিল। সাকার ও বয়লার মেশিনে কোনো কালো ধোঁয়া বা আগুনে পোড়ার দাগ নেই, মেশিন দু’টিতে মাকড়শার জাল দেখা গেছে।
জরিপ প্রতিবেদন পাওয়ার পর সোনালী সার্ভের প্রতিবেদনটি মিথ্যা বলে আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেন এসবি নিটওয়্যারের মালিক আব্দুর রহমান।
এ অভিযোগে তিনি বলেন, বিমা পলিসি দু’টির একটি নবায়ন করা হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের ৩ দিন আগে এবং অন্যটি ১ মাস ৩ দিন আগে। এছাড়া প্রতিমাসে এলসি করা হয়েছে। আর জানুয়ারি মাসে একদিন (২২ তারিখ), ফেব্রুয়ারিতে পাঁচদিন (৪, ১১, ১৭, ২৬ ও ২৮ তারিখ) এবং মার্চে তিনদিন (৩, ১১ ও ২৫ তারিখে) শিপমেন্ট করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, কারখানা বন্ধ ছিল না।
মাকড়শার জালের বিষয়ে বলা হয়, ফায়ার ব্রিগেডের হোস পাইপ দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি নিক্ষেপের কারণে কারখানার ভেতরে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি পানি জমে যায়, অথচ সেই পানিতে কারখানার ভেতরে থাকা সাকার ও বয়লারের মাকড়শার জাল ছিড়ে যায়নি এটাও অবান্তর। এতেই প্রমাণিত হয় সার্ভে রিপোর্টটি মিথ্যা। আর ফায়ার ব্রিগেডের জমে যাওয়া পানি থেকেই বোঝা যায় আগুনের ভয়াবহতা।
আব্দুর রহমান অভিযোগে আরও বলেন, জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কিছু কার্টুন আধা পোড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। অধিকাংশ কার্টন ফায়ার ব্রিগেডের ছোড়া পানিতে বিনষ্ট হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, সার্ভেয়ার অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া কারখানার মূল প্যাকিং ও ফিনিশিং সেকশনের চিত্র তুলে ধরেননি। নিজস্ব উদ্দেশ্যে সাধনে কারখানার পুড়ে যাওয়া অংশের আশপাশের চিত্র তুলে ধরেছেন।
এ অভিযোগের পর দ্বিতীয় জরিপের জন্য মেসার্স এশিয়ান সার্ভেয়ার্সকে নিয়োগে দেয় আইডিআরএ। এ জরিপ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন সম্পর্কে আইডিআরএ’র নথিতে বলা হয়েছে, এশিয়ান সার্ভেয়ার্সের জরিপে নিট ক্ষতির পরিমাণ ১৬ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ক্ষতি নির্ধারণের বিষয়ে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ দ্রব্যাদি সরিয়ে ফেলার কারণে সেগুলো দেখা ও পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে কাগজপত্র ও ক্ষতিগ্রস্থ সম্পত্তির ছবির ওপর নির্ভর করে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসবি নিটওয়্যারের মালিক আব্দুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমি ২৬ জানুয়ারি আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করি। কিন্তু প্রায় ১০ মাস পার হয়ে গেলেও দাবির টাকা পাইনি। এ কারণে এলসিও খুলতে পারছি না। শ্রমিকদের নিয়ে বেশ কষ্টে আছি।
তিনি বলেন, শুনেছি, আইডিআরএ আমার অভিযোগের ভিত্তিতে নতুন করে জরিপ করেছে। তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। এজন্য জরিপ প্রতিষ্ঠান দু’টিকে শুনানিতেও ডেকেছে। কিন্তু এরপর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে আইডিআরএ থেকে আর কোনো তথ্য পাইনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
এএসএস/এএসআর