ঢাকা: অধিকাংশ কোম্পানি সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) বা পণ্যের গুণগত মান সনদ গ্রহণ না করেই পণ্য বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ অনেকদিনের।
পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অধিকাংশ কোম্পানি এ সনদপত্র গ্রহণ না করে অবৈধভাবে বিএসটিআই’র মানচিহ্ন ব্যবহার করে পণ্য বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ পেয়েছে সংস্থাটি।
যদিও যেকোনো পণ্য বাজারজাতকরণের আগে পরীক্ষাগারে পণ্যের মান পরীক্ষার মাধ্যমে এ সনদপত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি বিএসটিআই সারাদেশে বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। অভিযানে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে সংস্থাটি। সে অনুযায়ী একটি তালিকাও করেছে।
শিশুখাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু পণ্যের সিএম সনদ পাননি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এজন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা ও অনেক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন শিশুখাদ্য, গুঁড়োদুধ, সস, চিনি, ড্রিংকিং ওয়াটার, বিস্কুট, কেক, আইসক্রিম, চানাচুর, রুটি, ফ্রুট জুস, ভোজ্য তেল, ঘি, নুডলস ও লাচ্ছা সেমাই।
এছাড়া কসমেটিকস, সানস্ক্রিন ক্রিম, শ্যাম্পু, লোশন, সাবান, মশার কয়েল, লিপস্টিকসহ বিভিন্ন দেশি পণ্য রয়েছে সিএম সনদহীনের তালিকায়।
বিএসটিআই সূত্র জানায়, একটি পণ্য বাজারজাতকরণের আগে পণ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা বিধানে (পণ্য পরীক্ষা) বিএসটিআই সিএম সনদ গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু দেশের অধিকাংশ পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি বিএসটিআই থেকে গুণগত মান পরীক্ষা ছাড়াই (সনদ না নিয়ে) পণ্য বাজারজাত করে আসছে।
পরীক্ষাবিহীন এসব পণ্যের গুণগত মান ঠিক রয়েছে কি-না, তা যাচাই করতে পারেন না ভোক্তারা। ফলে ভেজাল ও মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে।
বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের দাবি, জনবল সংকটের কারণে দেশের হাজার হাজার পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের সক্ষমতা তাদের নেই।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু উৎপাদনকারীরা সনদ না নিয়েও পণ্যের প্যাকেটের গায়ে বিএসটিআই’র মানচিহ্ন ব্যবহার করে ভোক্তাকে প্রতারিত করছেন।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারে ইয়াকুব আলী নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, প্যাকেটের গায়ে পণ্যের ফিরিস্তি দেখে পণ্য কিনি। মান ঠিক আছে কি-না তা তো জানি না।
মোহাম্মদপুর সিটি কর্পোরেশন মার্কেট রিয়াজ স্টোরের মালিক সেলিম রেজা বাংলানিউজকে জানান, ক্রেতারা লেখা দেখে কেনেন। মান ঠিক আছে কি-না জানি না।
তিনি বলেন, বিএসটিআই’র লোকজন নিয়মিত পরীক্ষা ও পরিদর্শন করলে বুঝতে পারতাম, কোন পণ্য মানহীন, কোন পণ্য বিএসটিআই অনুমোদিত না।
কোম্পানির লোকজনকে মান বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সরাসরি বিএসটিআই’র লোগো দেখিয়ে দেন। তারা বলেন, মান না থাকলে এ চিহ্নের সনদ দিল কিভাবে?
তবে সনদ না নিয়েও বিএসটিআই’র ‘এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার’ যোগসাজশে এসব উৎপাদনকারীরা পার পেয়ে যান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি ঢাকার মৌলভীবাজারে সিএম সনদ গ্রহণ না করে ‘ক্রিম মিল্ক পাউডার’ উৎপাদনের অপরাধে একটি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে থাকা বিএসটিআই’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, শিশুখাদ্য খুবই স্পর্শকাতর।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অনেকদিন থেকেই এ গুঁড়োদুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এ দুধ শিশুকে খাওয়ালে স্বাস্থ্যহানিসহ মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে।
এ প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান শিশুখাদ্যসহ বহু পণ্য পরীক্ষা ছাড়াই উৎপাদন করছে। তবে সঠিক তদারকি আর সচেতনতার অভাবে এমন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মানহীন পণ্য বাজারজাত করা বেআইনি বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইএনএফএস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আলেয়া মাওলা।
তিনি বলেন, বিএসটিআই এসব লাইন্সেসবিহীন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কোম্পানিকে সময় দিতে পারে। ব্যবস্থা না নিলে মানহীন পণ্য ঠেকানো যাবে না।
পরীক্ষা ছাড়া বাজারের এসব পণ্য মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করতে ও প্রাণঘাতী রোগ দেখা দিতে পারে বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মানহীন খাদ্য গ্রহণে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, খাবারে অরুচি ও হৃৎপিণ্ডে ক্ষত সৃষ্টির মতো স্বল্পমেয়াদী নানা রোগ দেখা দিতে পারে।
একইসঙ্গে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি ও ফুসফুস আক্রান্তের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগও দেখা দেওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি হতে পারে।
বিএসটিআই’র পরিচালক কমল প্রসাদ দাস (সিএম) বাংলানিউজকে বলেন, সরকার ঘোষিত ১৫৫টি পণ্যে সিএম সনদ একেবারেই বাধ্যতামূলক।
তিনি বলেন, এসব পণ্য সনদ না নিয়ে উৎপাদন, বাজারজাত করলে সর্বনিম্ন ৭ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এ সনদ দেওয়ার মাধ্যমে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত মানের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। এ সনদ না থাকলে পণ্যের গুণগত মান নেই বুঝতে হবে।
শত শত পণ্য এ সনদ গ্রহণ না করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে তা প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান কমল প্রসাদ দাস।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
আরইউ/এএসআর