পঞ্চগড়: গত কয়েক অর্থবছরে মোট উৎপাদিত চিনির মধ্যে অবিক্রিত ৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুদ রেখেই আগামী ১৮ ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে লোকসানমুখী পঞ্চগড় চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম।
অবিক্রিত এ চিনির বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকারও বেশি।
গত কয়েক অর্থ বছর থেকে টানা লোকসান গুণছে পঞ্চগড় জেলার সবচেয়ে পুরোনো ও সর্ববৃহৎ এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, যান্ত্রিক ত্রুটি, কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিপুল পরিমাণ চিনি অবিক্রিত থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হচ্ছে এ চিনিকলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫-৬৯ সালের সরকারের সময়ে দেশের সর্বউত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ৫৫.৫৫ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ১৯৮.৪৬ একর জমির উপর স্থাপন করা হয় পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড।
১৯৬৯ সাল থেকে পরীক্ষামূলক আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হতো এ মিল থেকে। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে লোকসান গুণছে মিলটি।
১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৬১২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে ১৪ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। তার পর থেকেই চলছে লোকসান।
২০১১-১২ অর্থ বছরে ২৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। গত ২০১২-১৩ অর্থ বছরে লোকসান হয়েছে ২৬ কোটি টাকা।
এদিকে ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে ১৮শ’ মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ অর্থ বছরের ৪ হাজার ২৩১ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে উৎপাদিত ৬ হাজার ২৫১ মেট্রিক টন ও ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে উৎপাদিত ৩ হাজার ৫১৮ মেট্রিক টন চিনির মধ্যে ৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি অবিক্রিত অবস্থায় গুদামে মজুদ রয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকারও বেশি।
বিদেশ থেকে চিনি আমদানির ফলে দেশি চিনিতে লোকসান হওয়ায় ডিলারদের চিনি উত্তোলনে অনীহা দেখা গেছে। ফলে দীর্ঘদিন পরে থাকায় লোকসানের পাশাপাশি চিনির গুনগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
চিনি বিক্রি না হওয়ায় আখ চাষিদের পাওনা টাকা পরিশোধ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে পাওনা টাকা আদায়ের দাবিতে বেশ কয়েকবার আখ চাষিদের আন্দোলনের মুখে পড়তে হয় চিনিকল কর্তৃপক্ষকে।
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের টাকার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে চিনির বস্তা। বাজারে চিনির মূল্য কম হওয়ায় তাদের নির্ধারিত ভাতার চেয়ে কম পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
পঞ্চগড় জেলার আখ চাষ উপযোগী ৩০ হাজার একর জমির মধ্যে ১০ হাজার একর জমি আখ চাষের আওতায় আনা হয়েছে।
২০১২-১৩ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৫শ’ একর জমিতে ৭২ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে ৭০ হাজার ৯৬৯ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। চিনি ৪ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ হাজার ২৩১ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়।
২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৫শ’ একর জমিতে ৯০ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে ৯৪ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। চিনির লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার মেট্রিক টন হলেও তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৬ হাজার ২৫১ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হলে আখ উৎপাদন হয় ৬১ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন। চিনির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন হলেও উৎপাদিত হয়েছে ৩ হাজার ৫১৮ মেট্রিক টন।
২০১৫-১৬ অর্থ বছরে সাড়ে ৪ হাজার একর জমিতে আখের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
চিনি বিক্রি না হওয়ায় গুদামে জায়গা সংকট ও আখ চাষিদের বকেয়া বেতন দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
দেশের প্রাচীন এ চিনি কলটি দিন দিন প্রাণ হারাতে বসেছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ৩৭ জন কর্মকর্তা, ৩শ’ জন কর্মচারী, ২শ’ জন স্থায়ী শ্রমিক ও মৌসূমী শ্রমিকসহ মোট একহাজার জন ব্যক্তির পরিবারও এগিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।
পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, ইতোমধ্যে আখ চাষিদের সব পাওনা টাকা শোধ করা হয়েছে। ডিলারদের চিনি উত্তোলনে আগ্রহ বাড়াতে চিনির মূল্য কমিয়ে প্রতি কেজি চিনি ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আমদানি ও বাজার মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্যমূলক নীতিমালা প্রণিত হলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো কিছুটা সমাধান হতে পারে। এছাড়াও এসব সংকট নিরসনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৫
আরএ