ঢাকা: সবার মুখেই এক কথা- বাংলাদেশই সেরা, বাংলাদেশই বড় মার্কেট, বাংলাদেশেই বড় সম্ভাবনা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে ক্রেতাদের কথা যেমন এই, বিক্রেতাদের ভাবনাও তেমনটাই।
কনভেনশন সেন্টারের চারটি বিশাল বিশাল হলরুমের সবগুলোতেই চলছে এই বিশাল আয়োজন। ছোটবড় সব মেশিনে সজ্জিত হলগুলোতে ঢুকলে একনজরে মনে হবে কোনও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিই বুঝি। আধুনিক সব মেশিনের অত্যাধুনিক ফ্যাক্টরিগুলো ঠিক এমনটাই হয়।
এতে সবকাজ হয়ে যায় নিমিশে, নয়তো সংক্ষিপ্ত সময়ে। তাতে প্রোডাকশন বাড়বে, কোয়ালিটি বাড়বে, ভ্যারাইটি বাড়বে, আর তার মধ্য দিয়ে বাজার বাড়বে, বাড়বে রপ্তানি আয়, বাড়বে মজুরি, বাড়বে শ্রমিকের জীবন মান। সবমিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে।
হল নং-১ এ একটি মেশিনকে ঘিরে ভিরটা একটু বেশিই দেখা গেলো। অটোমেটিক শার্ট কাফ ব্লাইন্ড স্টিচিং মেশিন এর নাম। ওটি ক্রস ব্রিড করা হয়েছে চিনা ওয়েশির বডি আর জাপানি জুকির মেশিনারিজ মিলিয়ে তৈরি এই মেশিন বাজারে এনেছে হংকংভিত্তিক ভেইট। আর তিন দেশের যৌথ প্রচেষ্টায় এই মেশিন চতূর্থ দেশ বাংলাদেশে এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মেশিনটিতে তৈরি হয় শার্টের কলার ও কাফ। প্রতি দুই মিনিটে তৈরি হয়ে যায় ছয়টি কলার। লোকবল মোটেই একজন।
কথা হচ্ছিলো ওয়েশির ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ডিপার্টমেন্ট’র সেলস ম্যানেজার মাইক ঝেংয়ের সঙ্গে। ভীষণ ব্যস্ত। দেশের আগ্রহী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা আসছেন তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এই মেশিনের বিশেষত্ব।
বাংলানিউজের সঙ্গে যখন কথা বলার ফুসরত মিললো, জানালেন এই মেশিনের অন্যতম দিকটিই হচ্ছে এর বডি ও মেশিন দুটি ভিন্ন কোম্পানির। দুটিই সেরা। আর তা থেকে সেরা সেবাটিই দেওয়া সম্ভব। জানালেন, সম্পূর্ণ কম্পিউটারইজড। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। প্রতি মিনিটে সুঁইয়ের ২৬০০ ফোঁড় পড়ে এই মেশিনে। একজন অপারেটর দিনে ৪২০০ কাফ বা কলার বানাতে পারে। আর তাতে লোকবল বেঁচে যায় তিন জন।
অন্তত ২৫ ধরনের আধুনিক মেশিন নিয়ে এসেছে জার্মানির ডারকপ এডলার। বাংলাদেশের বাজারে দুই দশকের বেশি সময় ধরে মেশিন সরবরাহ করে আসছে। নতুন নতুন স্বয়ংক্রিয় মেশিন নিয়ে প্রদর্শনীতে হাজির হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কথা হচ্ছিলো এর সার্ভিস ম্যানেজার স্টেফান গ্রাফের সঙ্গে। স্টেফান জার্মানি থেকে এই মেলা সামনে রেখে বাংলাদেশে এসেছেন তার ভাষায়, বাংলাদেশকে এখন টোটাল অটোমেশনে যেতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বের বড় বড় বায়ারদের ভরসার দেশ বাংলাদেশ। এখানে নতুন নতুন স্বয়ংক্রিয় মেশিন যত বেশি আসবে, উৎপাদন সময় ততই কমবে, আর বাড়বে উৎপাদন। বায়ার খুশি হবে।
পাশাপশি দুটি মেশিনে জিন্স প্যান্টের জিপারের বাটন প্লেট তৈরির মেশিন চালিয়ে দেখালেন স্টেফান। বললেন, দেখো আধা মিনিটে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একেকটি জিপার প্লেট। তাতে বোতামের ঘাটগুলো সেলাই হচ্ছে। পুরো কাজটিই কম্পিউটারের মাধ্যমে চলছে। এতে সুবিধা প্রতিটি ঘাটের ডিজাইন একই হচ্ছে, আর বসছে সমান দূরত্বে। একসঙ্গে দুটি মেশিনে কাজ করলে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বের হয়ে যাচ্ছে দুটি জিপার প্লেট।
জাপানভিত্তিক হাশিমা কোম্পনির অনেকগুলো মেশিন দেখা গেলো সোল্ড ট্যাগ লাগানো হয়েছে। বুঝা গেলো ক্রেতারা বেশ কিনছেন এসব মেশিন। ফিউজিং মেশিন, কাটিং মেশিন, নিডল ডিটেক্টর এসবে ঠাসা।
তবে ট্যাকোম্যাকের বিশালাকার অটো স্প্রেডিং মেশিনটি দৃষ্টি কেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
দেখা হলো দেশের অন্যতম তৈরিপোশাক শিল্পগোষ্ঠী ওপেক্স-এর সিইও মজিবুল ইসলাম খানের সঙ্গে। ঘুরে ঘুরে আধুনিক সব মেশিন দেখছিলেন, বিক্রেতাদের ব্রিফিং নিচ্ছিলেন। দুই দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা তার। জানালেন, অটোমেশনের সময় এটি, অতএব সেদিকেই যেতে হবে। কারখানা গুলো সেদিকে ঝুঁকছে।
এতে খরচ কেমন পড়ছে, সে প্রশ্নের জবাবে বললেন, মেশিন মাফিক দাম। আর যে মেশিনে যেমন সুবিধা, দামও তত বেশি। এখানে কাজের সুবিধার দিকটি বিবেচনায় যেমন রয়েছে, তেমনি বায়ারদের ইচ্ছার বিষয়টিও জরুরি। বায়ারদের চাপ রয়েছে এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ওপর, জানান মজিবুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ফ্যাক্টরি মালিকরা একসঙ্গে পুরোপুরি অটোমেশনে যেতে পারছেন না, কিন্তু যখন যতটুকু সুযোগ হচ্ছে, সামর্থ্যমতো সেটুকু কিনে নিচ্ছেন।
আরএমজিটেক মেলাকে একটি দারুণ উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন এই ব্যবসায়ী।
এতে লোকবলের ব্যবহার কমে যাবে, তাতে কর্মীদের চাকরি হারানোর সুযোগ রয়েছে কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যে কর্মীরা তৈরি হয়েছে তাদের কেউ হারাতে চায় না। দীর্ঘ সময় ধরে তারা দক্ষতা অর্জন করেছে। তাদের ধরে রাখার জন্য ব্যবসা বাড়ানো, ফ্যাক্টরি বড় করার ভাবনাই মালিকদের মধ্যে বেশি কাজ করে।
একই কথা বললেন, ভেইট হংকং লিমিটেড এর বাংলাদেশ অফিসের সেলস ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, অটোমেশনে লোকবল কম লাগলেও তৈরি পোশাকে চাকরিচ্যুতির সম্ভাবনা কম। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে, চীনের ১৭ হাজার ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বাংলাদেশের ওপর বায়ারদের চাপ বাড়ছে, আর তাতে ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজের সুযোগ কমছে না।
বাংলাদেশের ওপর বায়ারদের ভরসার কথা শোনা গেলো সবার মুখেই। চিনের মাইক ঝেং, জার্মানির স্টেফান গ্রাফ, কোরিয়ার জেডি চোই’র প্রত্যেকেই বললেন, তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা স্থান, তেমনি বায়ারদের ভরসার স্থানও।
আরেকটি প্যাভিলিয়নে কথা হচ্ছিলো দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক এসডব্লিউএফ’র সানস্টার লিমিটেড দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার আর এই ক্যাং (রিচার্ড) এর সঙ্গে। তিনি বললেন, অ্যাম্ব্রয়ডারিতে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনার কথা। একসঙ্গে ১৫টি অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করা যায় এমন একটি মেশিনের প্রদর্শনীতে ব্যস্ত ছিলেন। সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড এই মেশিন অন্তত ১৫ জনের কাজ একজনের পক্ষে করা সম্ভবপর করে তুলেছে। এরই মধ্যে দেশের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই অ্যাম্ব্রয়ডারি মেশিন। আর বাংলাদেশ যে সম্ভাবনা নিয়ে এগুচ্ছে তাতে এর কাটতি আরও বাড়বে বলে মনে করেন দক্ষিণ কোরিয়ার এই নাগরিক।
বাংলাদেশ যত দ্রুত এই খাতে টোটাল অটোমেশনে যাবে, ততই তার অবস্থা আরও দৃঢ় হবে বলেও বিশ্বাস এদের সবার।
বাংলাদেশ সময় ১৪৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
এমএমকে/
** সেলাই স্বয়ংক্রিয় করতে অত্যাধুনিক মেশিন