আশুলিয়া (ঢাকা) থেকে ফিরে: হারুন অর রশিদ (৪৩)। মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেড নামে তৈরি পোশাক কারখানার।
হারুন অর রশিদ ফরিদপুর জেলার সালথা থানার সোনাপুর গ্রামের মরহুম আব্দুল গফুর শেখের ছেলে। তৈরি পোশাক কারখানায় ‘ছোট’ চাকরি করতেন বলে জীবনে জুটেছে অনেক অবজ্ঞা-অবহেলা। এমনকি তার সঙ্গে মেয়েও বিয়ে দিতে চাননি অনেকে। অথচ পরিশ্রম দিয়ে এখন তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ তৈরি পোশাক কারখানার প্রধান। তার অধীনেই চাকরি করেন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী।
নিজের অতীতকে ভুলে যাননি তিনি। সম্মান করেন মানুষকে। শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও তাকে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় শ্রমিকদের পাশে। কখনো নিজেই বসে পড়েন সুইং মেশিনে। কখনো বা কোয়ালিটি সেকশনে শ্রমিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে কাজ করেন তিনি।
শ্রমিকদের কাছেও আপনজন হারুন অর রশিদ। গড়ে তুলেছেন শ্রমিকবান্ধব উৎপাদন পরিবেশ। শীর্ষ কর্মকর্তা হলেও নিজের অফিসরুমের দরজা খোলা সবার জন্য। সবাই মন খুলে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারেন তার কাছে। বিপদে-আপদেও শ্রমিকরা সহজেই তাকে কাছে পান।
মাত্র পাঁচ মাস বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর মা, দুই ভাই ও এক বোনকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।
কিভাবে শুন্য থেকে এতোদূর আসা সম্ভব? বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে ইচ্ছাশক্তিটাই যথেষ্ট। আমি সাবলম্বী হতে চেয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিলো, জীবনে যদি চৌকিদারও হই, তাহলেও আমাকে তাদের প্রধান হতে হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য বা স্বপ্ন যাই বলেন না কেন, থাকতে হবে আকাশ ছোঁয়ার। তবেই না আপনি ছাদ ছুঁতে পারবেন।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলতে থাকেন, বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। এর বাইরে ছিলেন মসজিদের খাদেম। বাবার আদর কী তা বুঝে ওঠার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। সামনে চলে আসে নিষ্ঠুর এক পৃথিবী। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি বড়খারদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালে এসএসসি পাশ করি নগরকান্দার এমএন একাডেমি থেকে। ভাবীর চাচাতো ভাই রইস মাতব্বর তখন সেনাবাহিনীর সৈনিক। পোস্টিং যশোরে। চলে গেলাম তার কাছে। তার আশ্রয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিই। রেজাল্ট হওয়ার আগেই ঢাকায় চলে এলাম।
ঢাকার জীবনে বিভিন্ন প্রতিকূলতা জয়ের গল্প জানাতে গিয়ে হারুন অর রশিদ বলেন, যার ভরসার ঢাকায় এলাম, সেই প্রতিবেশী আক্কাস আলী আমাকে আশ্রয় দিলেন না। তখন রাজধানী জুড়ে লাগাতার হরতাল। নতুন আগন্তুক হিসেবে সেই পরিস্থিতিতে আমি দিশেহারা। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেলাম সাভারে। আমার সেই ভাবীর মেঝো চাচার ছেলে হিরু মাতব্বর সাভার ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করতেন। বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে গেলাম তার কাছে। পরম স্নেহে ফিরোজা ভাবী ঠাঁই দিলেন। চাকরি করবো, নাকি টিউশনি করবো- এই নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। হরতাল বন্ধ হবার পর আবার ঢাকায় ফিরে মেসে উঠলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, চাকরিই করব। রেজাল্ট হবার আগেই মিরপুর ১৪ নম্বরে এমবিএম গার্মেন্টসে চাকরি নিলাম। পদের নাম কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর। বেতন মাত্র ৮শ’ টাকা। এর মাঝেই রেজাল্ট বেরুলো। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকলাম। ভর্তি হলাম মিরপুর কলেজে। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে এমবিএম গার্মেন্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম নাসির উদ্দিন খান আমাকে উৎসাহ দিতেন। আমি কখনো প্রাইভেট পড়িনি। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিতাম। ১৯৯৭ সালে বিএসএস পাশ করলাম। একই বছরের ১৮ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় বড় ভাই মারা গেলেন। তার স্বপ্ন ছিলো, আমাকে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে দেখার। আমিও ভাবতাম, জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে।
জীবন সংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত তিনি বলেন, তখন ভাবী, তার চার বছরের ছেলে, এক বছরের মেয়ে, মা ও বোনকে নিয়ে আমার জগৎ। সব মিলিয়ে মানসিক ও পারিবারিক দুর্যোগ নেমে এলো জীবনে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে চলে গেলাম গ্রামে। সেখানে থাকলাম প্রায় নয় মাস। এরপর আবার ঢাকায় ফিরলাম। চাকরি নিলাম পুরান ঢাকার আরমানী টোলায় লাভক্র্যাফট গার্মেন্টসে, ফ্লোর চিফ হিসেবে। বেতন সাড়ে আট হাজার টাকা। সুবিধা হলো, সেখান থেকে কাছেই জগন্নাথ কলেজ। নৈশ বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম সমাজ কল্যাণ বিষয়ে। লাভক্র্যাফটে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে বেতন দাঁড়ালো সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ১৯৯৯ সালে তেঁজগাওয়ে বেসিক গার্মেন্টসে প্রোডাকশন ম্যানেজার (পিএম) হিসেবে চাকরি নিলাম। বেতন ২২ হাজার টাকা। ততদিনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছি।
এরপর শুরু উপরে ওঠার গল্প। তিনি বলেন, ২০০১ সালে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) একটর স্পোটিং লিমিটেড নামে চায়নার মালিকানাধীন পোশাক কারখানায় জয়েন করলাম সাড়ে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে। ওভারটাইম নিয়ে বেতন দাঁড়ালো প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার হিসেবে নানা বিষয়ে দেখভাল করতে হয়। গার্মেন্টস ইঞ্জিনিয়ারিং ও মার্সেন্ডাইজিং বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে সংশ্লিষ্টরা বলতো, এসব বিষয়ে তো তোমার কোনো ধারণাই নেই। জেদ চেপে গেলো। এর মধ্যে কী আছে আমাকে জানতে হবে। কাজের ফাঁকে ভর্তি হলাম বিজিএমইএ পরিচালিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন ডিজাইনিং টেকনিক্যাল একাডেমিতে (বিআইএফটিআইএ)। দু’টি বিষয়েই সাফল্যের সঙ্গে কোর্স শেষ করলাম। আগ্রহ জাগলো বিদেশি কোম্পানিগুলোর ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে জানার। কী করে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব, তা জানতে লিন ম্যানেজমেন্টে পড়তে চলে গেলাম চায়নার সাংহাইয়ে। নিজ খরচেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি অব সাংহাই থেকে ছয় মাসের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করলাম। সেখান থেকে ২০০৪ সালে দেশে ফিরে ম্যানেজার (প্রোডাশন প্ল্যানিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স) হিসেবে যোগ দিলাম পলমল গ্রুপে।
জীবনে ক্রমোন্নতির গল্প আরও দীর্ঘ হতে থাকে। হারুন অর রশিদ বলতে থাকেন, ২০০৫ সালে সিনিয়র ম্যানেজার প্রোডাকশন হিসেবে যোগ দিলাম এপিক গার্মেন্টস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানি লিমিটেডে। বেতন ৮০ হাজার টাকা। ছয় মাস পর পদোন্নতি পেয়ে হলাম জিএম। বেতন হলো ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার শখ হলো বিদেশি গার্মেন্টসের নাড়ি-নক্ষত্র জানার। ইন্টারভিউ দিয়ে সিলেক্ট হলে ২০০৬ সালের ১ জুন যোগ দিলাম চীনের হুং ইয়েন গার্মেন্টসে। জিএম প্রোডাকশন হিসেবে প্রথমেই বেতন সাড়ে তিন হাজার ডলার। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে বেতন দাড়াঁলো সাড়ে চার হাজার ডলারে। ১৬ লাইন থেকে ১১০ লাইনের দায়িত্ব পেলাম। এক পর্যায়ে হেড অব অপারেশনস হলাম। বেতন হলো সাড়ে ৬ হাজার ডলার। বর্তমান মানে যা ছিলো সোয়া ৫ লাখ টাকা। ২০১২ সালের জুনে দেশে ফিরে যোগ দিলাম গাজীপুরে লিবাইস টেক্সটাইলে, জিএম অপারেশনস হিসেবে। বেতন দেড় লাখ টাকা। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে যোগ দিই হা-মীম গ্রুপে, জিএম অপারেশনস হিসেবেই। কিছুদিন কাজ করার পর সেখান থেকে ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হেড অব ফ্যাক্টরি হিসেবে যোগ দিই বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে নিউ ঢাকা নামের কারখানায়। বেতন দুই লাখ টাকা। আমার কর্মদক্ষতার ওপর আস্থা রাখে বেক্সিমকো গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর আমাকে কারখানার গোটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) স্বতন্ত্র কারখানা বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডে।
বর্তমানে তিনি বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডেই আছেন। এখানে আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাদেই তিনি বেতন পান সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি।
হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই আমার একমাত্র বোন মরিয়মকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বাবার মৃত্যুর পর মা রুবিয়া বেগম আমাদের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন। এই পর্যন্ত আসতে আমাকে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেক অবহেলা-অবজ্ঞা সইতে হয়েছে। পড়াশুনা আর কাজ করতে করতে কখন গায়ের কালো লোমগুলো সাদা হয়ে গেছে, সে দিকেও তাকানোর সময় পাইনি। গার্মেন্টসের ‘ছোট চাকরি’ করি এই কারণে আমার জন্য কনে খুঁজে পাননি আমার মা। সেটা মায়ের একটা বড় দুঃখ ছিলো। শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালে এমবিএম গার্মেন্টসের কমার্সিয়াল বিভাগে কর্মরত হামিদা বেগমকে বিয়ে করি। সংসারে আমার চার কন্যা। সবাই পড়ছে সাভারের মর্নিং গ্লোরি স্কুলে।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার সংসারের দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন জানিয়ে এই সফল কর্মকতা বলেন, ভাইয়ের ছেলে আরাত হোসেন রনিকে বিবিএ’তে পড়াচ্ছি লন্ডনের বিখ্যাত অক্সফোর্ডে আর মেয়েটি পড়ছে ম্যানেজমেন্টে সরকারি সারদা সুন্দরী কলেজে।
তিনি বলেন, আমার কাছে মানুষই বড়। প্রতিটি শ্রমিক ভাই-বোনের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। কারণ তাদের জন্যই আমরা। কখনো তাদের সামনে আমি গাড়ির হর্ন পর্যন্ত বাজাই না। গ্রামের প্রতি আমার বেশি দরদ। গ্রামের অভাবী-মেহনতি মানুষদের পাশে সামর্থ্য মতো দাঁড়াই। এই যে আমার গায়ে সোয়েটার দেখছেন, এই কোয়ালিটির তিনশ’ সোয়েটার আমার গ্রামের মানুষদের মাঝে বিতরণ করেছি।
জীবনে যতোই অবহেলা আর অবজ্ঞা আসুক না কেন, দৃঢ় মনোবল আর সঠিক লক্ষ্য থাকলে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। প্রয়োজন কেবল দৃঢ়তা আর মানসিক শক্তি, যোগ করেন হারুন অর রশিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫
আরএম