পার্বতীপুর (দিনাজপুর): পাথর উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত প্রধান খনন যন্ত্র’রেইজ বোরিং মেশিন’ (Raise Boring Machine) দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া পাথর খনিতে এসে পৌঁছেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকালে রেইজ বোরিং মেশিনটি চিটাগাং পোর্ট থেকে মধ্যপাড়া খনিতে এসে পৌঁছায়।
এর আগে গত ৩১ মার্চ খনি ভূ-গর্ভে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ব্যবহারের জন্য দু’টি ট্রাক ভর্তি ওয়াটার অ্যান্ড এয়ার হুস পাইপ খনিতে নিয়ে আসা হয়।
তবে মূল খনন যন্ত্র এলেও সহসাই পাথর উৎপাদন শুরু হচ্ছে না। কারণ আমদানিকৃত সব মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট না আসা পর্যন্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসি খনি ভূ-গর্ভে নতুন স্টোপ (পাথর উৎপাদন ইউনিট) উন্নয়ন কাজ শুরু করবে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, প্রায় তিন মাস ধরে মধ্যপাড়া খনিতে কোন পাথর নেই। ফলে পাথর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভারত থেকে পাথর আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শিগগির উৎপাদন শুরু করা না হলে ক্রেতাদের ধরে রাখা যাবে না। ফলে পরবর্তীতে উৎপাদন শুরু হলে আবারও পাথর বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে খনি কর্তৃপক্ষকে।
পাথর উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত প্রধান খনন যন্ত্র সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের (মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট) অভাবে প্রায় সাত মাস ধরে মধ্যপাড়া খনিতে পাথর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, অব্যাহত লোকসানের মুখে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে মধ্যপাড়া খনির উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ঠিকাদার হিসেবে বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোসট্রয় ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া কর্পোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) সঙ্গে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী জিটিসি ১৭১.৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ৬ বছরে ৯২ লাখ (৯.২ মিলিয়ন টন) টন পাথর উত্তোলন করে দেবে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে এক শিফটে পাথর উৎপাদন শুরু করে। জিটিসি উৎপাদন শুরুর ৬ মাসের মধ্যে প্রতিদিন তিন শিফট চালু করে গড়ে পাথর উত্তোলন সাড়ে ৪ হাজার টনে উন্নীত করে।
সূত্রমতে, মাইনিং ইক্যুইপমেন্টের অভাবে নতুন স্টোপ উন্নয়ন করতে না পারায় মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে পাথর উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এর আগে ৩১ জুলাই খনির ৩ শিফটের মধ্যে ২ শিফট বন্ধ করে দেওয়া হয়। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জিটিসি’র অধীনে খনিতে কর্মরত প্রায় ৬০০ খনি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
এ অবস্থার সৃষ্টি হবে খনি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আগেই বুঝতে পেরে তৃতীয় শিফট চালু না করার জন্য জিটিসিকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু জিটিসি নিজেদের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় খনি কর্তৃপক্ষের কথা আমলে নেয়নি।
সূত্র জানায়, জিটিসি ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় ১৪৪ কোটি টাকার প্রয়োজনীয় মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করার জন্য খনি কর্তৃপক্ষকে চাহিদাপত্র দেয়। চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন সহায়ক সবধরনের মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবে খনি কর্তৃপক্ষ। চাহিদাপত্র পাওয়ার এক মাসের মধ্যে মালামাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার কথা।
কিন্তু মাইনিং ইক্যুইপমেন্টের বাজারমূল্য ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নিয়ে জিটিসির সঙ্গে খনির তৎকালিন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকের মতবিরোধ দেখা দেয়। তাছাড়া উৎপাদিত পাথর বিক্রিতে ধীর গতির কারণে অর্থসংকট দেখা দেওয়ায় সময়মত তা আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়নি।
পরে খনি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা মধ্যপাড়া খনির তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবুল বাসার ও জেনারেল ম্যানেজার (জিএম-মার্কেটিং) ফজলুল হককে অপসারণ করে এবং অর্থ সংকট কাটাতে মধ্যপাড়া খনিকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়।
পেট্রোবাংলার ঋণ পাওয়ার পর খনি ভূ-গর্ভে নতুন স্টোপ উন্নয়ন ও উৎপাদন সহায়ক অতি প্রয়োজনীয় মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আমদানির জন্য সেপ্টেম্বর মাসে অগ্রণী ব্যাংক কাওরান বাজার (ঢাকা) শাখায় এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়। এলসি খোলার পরপরই জিটিসি মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট উৎপাদনকারী চীন ও রাশিয়ার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তা সরবরাহের জন্য অর্ডার দেয়।
সূত্র জানায়, প্রথম অবস্থায় রাশিয়া ও চীন থেকে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার ৩৪টি প্রোফর্মায় অন্তর্ভূক্ত শতাধিক আইটেমের মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট আমদানি করা হচ্ছে। মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে চীন ও রাশিয়া থেকে দু’টি জাহাজ গত ২ মার্চ এবং ৪ মার্চ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছে। আরও কিছু মালামাল দেশে আসার পথে রয়েছে বলে জিটিসি’র জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) জাভেদ সিদ্দিক বাংলানিউজকে জানান।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সদ্য যোগদানকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নওশাদ ইসলাম ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম-অপারেশন) মীর আব্দুল হান্নান বাংলানিউজকে জানান, মূল খনন যন্ত্র এলেও আমদানিকৃত অন্যান্য মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট না আসা পর্যন্ত জিটিসি নতুন স্টোপ উন্নয়ন কাজ শুরু করবে না বলে তাদের জানিয়েছে। ফলে কবে নাগাদ পাথর উৎপাদন শুরু হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
খনির মহাব্যবস্থাপক (জিএম-প্রশাসন ও বিপণন) নেয়াজুর রহমান জানান, জিটিসি এ পর্যন্ত উত্তোলন করেছে ১১ লাখ ৯২ হাজার টন পাথর। উৎপাদন বন্ধ হওয়ার সময় খনি ইয়ার্ডে বিভিন্ন সাইজের প্রায় ৭ লাখ টন পাথর মজুদ ছিল। গত জানুয়ারি মাসের মধ্যে তা বিক্রি হয়ে গেছে।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় অবস্থিত মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে ২০০৭ সালের ২৫ মে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। তখন থেকেই খনিটি খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। সে সময় পাথর উৎপাদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খনি বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার উত্তর কোরিয়ার নামানাম কোম্পানিকে।
২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৬ বছরে খনিটি লোকসান করেছে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। এ লোকসানের অন্যতম কারণ হলো প্রতিদিন তিন শিফটে ৫ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এক শিফটে মাত্র ১ হাজার মেট্রিক টন পাথর উৎপাদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৬
আরএ