ঢাকা: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিলো মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। খোয়া যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে ফিলিপাইনের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে কমিটি।
রোববার (১৫ মে) দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়।
কমিটির সভাপতি ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, মো. আব্দুল ওয়াদুদ, টিপু মুন্সি, ফরহাদ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও আখতার জাহান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এবি ব্যাংককে তলব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। এছাড়া পানামা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বৈঠকে বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটি নিশ্চিত হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিলো। এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিলো। ফেডারেল ব্যাংকও চাইলে আরও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারতো। আর ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের টাকা আটকানোর সুযোগ ছিলো। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
তিনি আরও বলেন, কিছু টাকা উদ্ধার হয়েছে। বাকি টাকা উদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিপাইনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ব্যাংকের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের সুপারিশ করা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে ফেরত পাওয়া গেছে। আরও প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে। বাকি অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কিন্তু বাকি অর্থ কিভাবে আসবে, আদৌ আসবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। কমিটি বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি দেশের জনগণের অর্থ ফেরত আনার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছে। এছাড়া ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার জোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া বৈঠকে অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তে এবি ব্যাংককে তলবের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিচালিত অফশোর ব্যাংকিং-এর সার্বিক ঝুঁকি হ্রাস এবং তুলনামূলকভাবে মুক্ত ও সহজ অফশোর ব্যাকিং সুবিধার সার্বিক সুফল নিশ্চিত করতে বিদ্যমান অফশোর ব্যাকিং নীতিমালা সময়োপযোগী করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
এবিষয়ে কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, অফশোর ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এবি ব্যাংককে ডাকা হবে। অন্য কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তাও খতিয়ে দেখা হবে।
কমিটি সূত্র জানায়, অফশোর ইউনিট থেকে চার বিদেশি কোম্পানির নামে ৪ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৩৪০ কোটি) বের করে নেওয়া হয়েছে। ঋণের অর্থ অন্য হিসাবে পাচার করা হয়েছে। অর্থ পাচার হয়েছে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই প্রতিষ্ঠান চারটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিং ও সেমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিং, সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেড ও ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেড। এ ঋণের অন্যতম সুবিধাভোগী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস। তিনি এবি ব্যাংকেরও সাবেক চেয়ারম্যান বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বহুল আলোচিত পানামা পেপার্সের নথিতে নাম থাকা বাংলাদেশিদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান করছে বলে কমিটিকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কমিটির আগামী বৈঠকে এবিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার জন্য বলা হয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। কমিটির পক্ষ থেকে তাড়াতাড়ি অনুসন্ধান শেষ করে জড়িতদের তালিকা কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছে। আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
চলতি মাসের শুরুতে পানামা পেপার্স নিয়ে প্রকাশিত একটি তথ্যভাণ্ডারে অন্তত ১৮ বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়। যারা বিদেশি ঠিকানা ব্যবহার করে শেল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হয়েছেন। দি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্শিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিস্টস (আইসআইজে) ফাঁস করা পানামা পেপার্স থেকে দুই লাখের বেশি অফশোর কোম্পানি, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের তথ্য প্রকাশ পায়।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিদ্যমান ভ্যাট আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দাবিও বিবেচনায় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এনিয়ে আলোচনাকালে অর্থমন্ত্রী এবিষয়ে সংসদের আগামী অধিবেশনে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৬
এসএম/আরআইএস/পিসি