ঢাকা: পোশাকের সাথে কাজটা বেমানান। পুরো পরিপাটি পোশাকে তাকে দেখা গেলো সব্জি বাগানে।
কে বলবে? খানিক আগে এই মানুষটিই বিদেশি পোশাক ক্রেতাদের সাথে বৈঠক করে এসেছেন। চোস্ত ইংরেজিতে ওদের সামলিয়েছেন। সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ক্রেতার চাহিদা মতো সময়ে পোশাক তৈরি ও রপ্তানি কিভাবে করা যায় তার খুঁটিনাটি দিকগুলোই বলছিলেন তিনি। আর বায়াররা যখন বিদায় নিলেন, তখন হাতে চলে এলো এতটুকু অবসর। আর সেটুকু সময় হাতে নিয়েই তিনি ছুটে গেলেন নিজের হাতে গড়া এই বাগানের সবুজ প্রকৃতির মাঝে। কারখানা ঘেঁষেই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের অবসর যাপনের এই সেরা আয়োজন।
তিনি হারুন অর রশীদ,৪৪। ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অন্যতম বৃহৎ শিল্প পরিবার বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো ফ্যাশনস্ নামের পোশাক কারখানার জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অব ফ্যাক্টরি।
কারখানার চারপাশের আর্বজনা, টুকরো কাপড়ের ঝুট আর ইট বালুর জঞ্জাল পরিস্কার করে সেখানে পটে আঁকা ছবির মতোই একেঁছেন সবুজের হাসি। কারখানা লাগায়ো পরিত্যক্ত এক চিলতে জমির সদ্ব্যবহার করে চারিদিকে গড়ে তুলেছেন ফুল, ফল আর নানা জাতের সব্জির বাগান।
কি নেই সেখানে! বরবটি, চাল কুমড়া, গ্রীস্মকালীন টমেটো, তিন প্রকারের ডাঁটা শাক, পুঁইশাক, ঢেড়স, বেগুন, আম, কলা, ডালিম, কাঁঠাল।
বৃষ্টির ছাঁট পেয়ে পুঁই শাকের ডগা লকলক করছে। তরতাজা বরবটি বা ঢেড়ঁস দেখে মনে হবে খেয়ে নয়, একটু ছুঁয়ে দেখি।
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের পুরনো জোনে ঢুকলে হাতের ডান দিকে মোড় নিতেই সীমানা ঘেঁষে গড়ে তোলা কারখানা ভবনের চারপাশে চোখে পড়বে নন্দন সবুজ প্রকৃতি।
গ্রীস্মের উত্তাপ ছড়ানো পিচঢালা সড়ক। সারি সারি কারখানা ভবন। হাজার হাজার শ্রমিক। চারপাশে ইট পাথরের জঞ্জাল। তার মাঝে পোশাক কারখানার বাড়তি উত্তাপ। মেশিনের শব্দ। এটাই শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ।
তার মাঝেই সবুজের এই পরিবেশ বিস্ময়ে অভিভূত করে শ্রমিক কর্মচারীদেরও। তারাও ফিরে যান ফেলে আসা গ্রাম বাংলার সবুজ সতেজ পরিবেশে।
বেক্সিমকো ফ্যাশনস্ ২১ 'শ শ্রমিক, কর্মকর্তা আর কর্মচারিদের ভালোমন্দ, সুযোগ সুবিধা, উৎপাদন, পরিচালন সবকিছু সামলে অবসরের অবশিষ্ট সময়টুকু হারুন অর রশিদ ব্যয় করেন এই বাগানে।
ফরিদপুরের সালথা সোনাপুর গ্রামের আব্দুল গফুর শেখের ছেলেই এখন বিশাল এই কারখানাটির জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অব ফ্যাক্টরি।
২ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার ছোট। এই কারখানার সাথে যুক্ত হয়েছেন মাত্র আড়াই বছর।
অকপটে জানালেন নিজের জীবনের কষ্ট আর সংগ্রামের কথা।
বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। কিন্তু বাবার আদর কী তা বুঝে ওঠার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। সামনে চলে আসে নিষ্ঠুর বাস্তবতা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন বড়খারদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালে এসএসসি পাশ করেন নগরকান্দার এমএন একাডেমি থেকে।
এরপর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের আশ্রয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। আর রেজাল্ট হওয়ার আগেই ঢাকায় চলে আসেন। এরপর শুরু হয় আরও সংগ্রাম আর কষ্টের জীবন। গার্মেন্টস ট্রেডেই কর্ম জীবনের সূচনা।
মাত্র ৮'শ টাকা মাইনের কর্মচারি হয়ে এই পেশায় কাজ শুরু। এর মাঝেই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। কঠোর পরিশ্রম, সততা আর একাগ্রতাকে সঙ্গী করে আজকের এই পর্যায়ে আসার জন্যে নিজেকে তৈরি করেন।
আজ আমি দেশ সেরা একটি শিল্প পরিবার পরিচালিত একটি বৃহৎ পোশাক কারখানার জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অব ফ্যাক্টরি হলেও আমার সব সময় মনে পড়ে আমি একজন সাধারণ কৃষকের সন্তান। গ্রাম থেকে উঠা আসা একজন মানুষ, বাংলানিউজকে বলেন হারুণ অর রশিদ।
স্ত্রী হামিদা বেগম ও চার কন্যা অাফসানা রিমি (১৫), হাসনা হেনা রিমকি (১৩), সামিরা সাল সাবিল ঋতু (১১), সানাইয়া ইরানী মিতু (৫)কে নিয়ে তার পরিবার। স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে এখনো প্রায়ই গ্রামে ছুটে যান।
আমি বলতে গেলে পুরোদস্তুর কৃষক। সন্তানরাও এতদিনে শিখে গেছে এই মাটি আর কৃষির প্রতি ভালোবাসা। মূলত ওদের এই চেতনা জাগ্রত করতেই গ্রামে যাওয়া, বলেন হারুন।
এ পর্যায়ে আরও নস্টালজিক হয়ে পড়েন হারুন অর রশিদ। বলেন, ‘ছাত্রাবস্থায় কত কি করেছি। একই গাছে জোড়া কলমে আট প্রকারের গোলাপ ফুল ফোটানোর কথা এখনো মনে পড়ে। ’
কেবল সব্জি চাষই নয়, কারখানার পূর্বদিকে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত চৌবাচ্চায় হারুন অর রশীদ মাছের চাষ করছেন। তাতে রয়েছে পাঙ্গাস, মাগুরসহ নানা ধরনের মাছ।
একটি বাড়ি একটি খামার। সরকারের এই উদ্যোগ এখন এই কারখানা ঘিরেও।
কেবল ফলন নয়। বীজ সংগ্রহ করা, রোদে শুকানো এগুলোও করেন ঠিকঠাক।
যখন এই ডালিম গাছের কাছে আসি তখন খুব বেশি মনে পড়ে পল্লীকবি জসিম উদ্দিন ও তাঁর অমর কবিতা ‘কবর’র কথা। আমিও তো কবির সেই ফরিদপুরেরই সন্তান। তাই হৃদয়ে সেই চেতনাটাও বেশ দোলা দেয়, বলেন হারুন।
আমি বিষমুক্ত পরিবেশেই সব্জি ফলাই। শ্রমিক কর্মচারিরা তা নিতে পারে। নিজের পরিবার,বন্ধু বান্ধবের চাহিদাও মেটে এখান থেকে।
কারখানা ঘিরে লাগানো অাম কাঁঠাল, ডালিম আর কলার ফলন ও বেশ। গাছে গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে ফজলিসহ নানা জাতের আম।
ছয়টা মাত্র আম গাছ। প্রতিটিতেই আম। সামান্য এই আম দিয়ে তো ২১'শ লোকের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। তাই একটি গাছের আম দিয়ে ক'দিন আগে রান্না হলো আম ডাল, জানালেন তিনি।
বিশ্বাস করবেন না। প্রতিদিন যেখানে সাত ড্যাগ ডাল রান্না হতো। আমের কারনে ডাল রান্না হলো ১২ ড্যাগ। আর বাড়তি চাল লেগেছিলো ৪২ কেজি। এত স্বাদের হয়েছিলো যে,সবার মুখে মুখে সেই স্বাদ এখনো লেগে আছে, বললেন একজন আনন্দিত হারুণ অর রশিদ।
‘বলতে পারেন আমার তৃপ্তির জায়গাটাই এখানে। ’
বাংলাদেশ সময় ০৯৫৪ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৬
জেডআর/এমএমকে