ঢাকা: কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় প্রায় সবাই নিজেদের লোক। এ সুযোগে ভুয়া বিনিয়োগ ও এজেন্ট কমিশন, অবৈধ ব্যবস্থাপনা ব্যয়, টিডিএসের নামে লেনদেন, বাড়ির মাসিক ও অগ্রিম ভাড়ায় নিজেদের খেয়াল খুশি মতো লেনদেন করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
তাতেও থেমে থাকেনি, ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে কোটি টাকা ভ্রমণে ব্যয় করেছেন কর্মকর্তারা। নিজস্ব ব্যক্তিদের পদোন্নতি দিয়েছেন। অথচ সব কিছু ঠিক থাকার পরও গ্রাহকদের বিমা দাবির নিষ্পত্তি করছে না কোম্পানিটি। যে কয়েকটি বিমা দাবি পরিশোধ করেছে, তাও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপে। এ টাকাও দিয়েছে দেরিতে, কিন্তু বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) জরিমানা দেয়নি।
ফলে গ্রাহকদের টাকা লুটপাটে ব্যস্ত থাকায় কোম্পানিতে তামাদি বিমার হার দিন দিন বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। অনেক প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের বিমার প্রথম কিস্তি নিয়ে পরে আর কোনো খোঁজ-খবরও নিচ্ছে না। ফলে তামাদি পলিসি বাড়ছে বছরে ৭০ শতাংশ হারে।
২০০১ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করে আসা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সংখ্যা ৯ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ৭ জন শেয়ারধারী উদ্যোক্তা পরিচালক আর দু’জন মনোনীত পরিচালক। এ সাতজনের মধ্যে আছেন- মেজর (অব.) মান্নান ও তার মেযে তাসনিমা মান্নান সোনিয়া, আলহাজ ফাইয়েজ আহমেদের দুই ছেলে মো. রাইয়েস উদ্দিন ও একেএম মুহউদ্দিন, তাদের দুইজনের স্ত্রী যথাক্রমে রাদিয়া রাইয়েস ও শাহনাজ মুহউদ্দিন। তারা সবাই নোয়াখালীর লোক এবং পরস্পরের আত্মীয়-স্বজন। অপর পরিচালক হলেন রোকেয়া ফেরদৌস। আর মনোনীত পরিচালকদের দু’জন হচ্ছেন- জিএম ফারুক খান ও লুৎফা মাওলা আইয়ুব।
আইডিআরএ’র নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সানফ্লাওয়ার লাইফ ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সাল- এ তিন বছরে এসব অনিয়মে ১৪০ কোটি টাকা অবৈধভাবে লেনদেন করেছে, যা বিমা আইন ২০১০- এর বিভিন্ন ধারা এবং বিমা বিধিমালার ধারা লঙ্ঘন। তাই আইন লঙ্ঘনের দায়ে বিমা গ্রাহকের স্বার্থে কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিমা আইনের ধারা ১০, ৫০, ৯৫ এবং ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। আইডিআরএ’র সদস্য মুরশিদ আলম এ নির্দেশ দিয়েছেন। কোম্পানি এর উত্তর দিতে ব্যস্ত রয়েছে।
কোম্পানির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সামসুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে যেসব ভুল ত্রুটি হয়েছে, সেগুলো কেন হয়েছে জানতে চেয়ে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা আগামী ৬ জুনের মধ্যে তার জবাব দেবো’।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে অনিয়ম ১১৮ কোটি টাকা
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের তুলনায় ১১৭ কোটি ৯২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭৩ টাকা বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে সানফ্লাওয়ার। বিমা বিধিমালা ১৯৫৮ এর ৩৯ বিধি মতে, প্রথম বর্ষ ব্যবসার জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ৯০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিটি নির্ধারিত সীমার চেয়ে ২০১২ সালে ৪৩ কোটি ১৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯১ টাকা বেশি ব্যয় করেছে, যা ৪৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। ২০১৩ সালে ৩৪ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার ৪০৮ টাকা বেশি দেখিয়েছে, যা ২৪ দশমকি ৩০ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালে ৪০ কোটি ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪ টাকা বেশি দেখিয়েছে, যা ১৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি ব্যয় করে ব্যবসা আহরণ করেছে। যা বিমা বিধিমালা ১৯৫৮ এর বিধি ৩৯ এর লঙ্ঘন এবং এতে আর্থিকভাবে বিমা গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম বর্ষের ব্যবসায় ব্যয় বেশি
কোম্পানি ২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে প্রথম বর্ষের ব্যবসা সংগ্রহে প্রিমিয়াম ব্যয় দেখিয়েছে যথাক্রমে ৮৮ দশমিক ৪১ শতাংশ, ৯৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ৮৫ দশমকি ৪২ শতাংশ। কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের ব্যয় ছাড়াই এ হিসাব দেওয়া হয়। তাও শুধুমাত্র ১ম বর্ষ ব্যবসা সংগ্রহের জন্য করা হয়। কিন্তু যদি প্রধান কার্যালয়ের ব্যয় এর সঙ্গে যোগ করা হয়, তবে ওই ব্যয় (বিমা বিধিমালা, ১৯৫৮ এর বিধি ৩৯ এ বর্ণিত ) প্রথম বর্ষ ব্যবসা আহরণে ব্যয় অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি হবে, যা ওই বিধির লঙ্ঘন।
টিডিএসের নামে অবৈধ লেনদেন
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ধারা ৫৩ (জি) এর বিধান অনুযায়ী, কমিশন থেকে উৎসস্থলে কর কর্তন (টিডিএস) করে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। কিন্তু গত তিন বছরে কোম্পানিটির কর ২ কোটি ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ২৭৫ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখার কথা থাকলেও রাখেনি।
এর মধ্যে ২০১২ সালে ৭৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৫ টাকা, ২০১৩ সালে ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৫ টাকা এবং ২০১৪ সালে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪৬৬ টাকা রাখার কথা ছিলো। সঠিকভাবে এ হিসাব না করায় প্রতি বছর সরকার টিডিএস খাত থেকে রাজস্ব হারিয়েছে, যা রাজস্ব আইন পরিপন্থী।
বাড়ি ভাড়া ও অগ্রিম ভাড়ায় অনিয়ম
গত ৩ বছরের কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, তার মধ্যে ৯ কোটি ৫২ লাখ ৭৪ হাজার ১১ টাকা বেশি দেখিয়েছে। আর অগ্রিম বাড়ি ভাড়া বাবদ ৬ কোটি ২২ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৭ টাকা কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে বেশি দেখিয়েছে।
নিয়ম অনুসারে কোম্পানির কাজে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তিপত্র অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। সেই হিসেবে কোম্পানির পক্ষ থেকে ২০১২ সালে চুক্তিপত্র অনুসারে বাড়ি মালিককে ৬১ লাখ ১৬ হাজার ৩৬৯ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে সেই হিসেব বাড়িয়ে ৪ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫১ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ২০১২ সালে বাড়ি ভাড়া খাতে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৩৮২ টাকার অনিয়ম হয়েছে। কোম্পানির হিসাবে ২০১৩ সালে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৬ টাকা। চুক্তিপত্র অনুসারে ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ১০৪ টাকা। এতে দেখা গেছে, ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২২ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
২০১৪ সালে কোম্পানির হিসাব মতে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯০৬ টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৫৯ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। অর্থাৎ ২ কোটি ৯৮ লাখ ৮০ হাজার ৭ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
একই ভাবে মালিকের চুক্তিপত্র অনুযায়ী অগ্রিম বাড়ি ভাড়া এবং কোম্পানির হিসাবে যে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৬ কোটি ২২ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৭ টাকার অনিয়ম হয়েছে। কোম্পানির হিসাব অনুসারে ২০১২ সালে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ১২৪ টাকা দেখানো হয়েছে। বাড়ি মালিকের চুক্তিপত্র অনুসারে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৫ টাকা দেখানো হয়েছে। এই হিসেবে ২০১২ সালে অগ্রিম বাড়ি ভাড়া বাবদ ২ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৬১ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
এর পরের বছর ২০১৩ সালে কোম্পানিটির অগ্রিম ভাড়া প্রদান ১ কোটি ৩০ লাখ ১০ হাজার ৯৭৩ টাকা দেখিয়েছে। চুক্তিপত্র অনুসারে ৩ কোটি ৩০ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৩ টাকা দেখানো হয়েছে। যা ২ কোটি ১২ হাজার ৮২০ টাকার গরমিল।
এ ছাড়াও ২০১৪ সালে কোম্পানির ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭১১ টাকা দেখানো হয়েছে। যা চুক্তিপত্র অনুসারে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৮ হাজার ৪০৭ টাকা দেখানো হয়েছে। যা ২০১৪ সালের হিসেবে ১ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৬ টাকার অনিয়ম।
লাখ টাকার ব্যবসায় কোটি টাকার ভ্রমণ
কোম্পানির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এক্সপান্স খাতে ব্যয় ৩১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৬৪ লাখ ৩৮ হাজার ১৩৩ টাকা হয়েছে, অর্থাৎ ১০২ শতাংশ বেড়েছে। ভ্রমণ ব্যয় খাতে ব্যয় ২০১২ সালে ১২ লাখ ৯৫ হাজার ১৬৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৫ টাকা। অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।
অন্যদিকে ২০১২ সালে ৯৪ কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯ টাকা থেকে ২০১৪ সালে ব্যবসা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ কোটি ১১ লাখ ১৮ হাজার ১৮১ টাকা, অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে। খরচগুলো ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য করা হয়নি এবং এ কারণে ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি হয়েছে। ফলে বিমা গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পদোন্নতিতে অনিয়ম
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করেনি সানফ্লাওয়ার লাইফ, যা প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের পরিপন্থী। এর মধ্যে সিজিএম থেকে এএমডি পদ টপকিয়ে ডিএমডি করা হয়েছে মো. সামছুল আলমকে। একইভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে মো. আব্দুর রহিমকে। এছাড়াও এ বি এম মহিউদ্দিন বাবলুকে এজিএম থেকে এএমডি করা হয়েছে জিএম পদ টপকিয়ে।
বিমা দাবি নিষ্পত্তি
কোম্পানির ৫০টি বিমা দাবির পরিমাণ ৯৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। বিধান অনুসারে ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও এখনো অনিষ্পত্তি অবস্থায় রয়েছে। যা বিমা আইন ২০১০ এর ৭২ (১) ধারা লঙ্ঘন। এ ছাড়াও ৪৪৩টি বিমা দাবি ৯০ দিনের পরে নিষ্পত্তি করে পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বিলম্বের জন্য বিমা আইনের ৭২ (২) ধারা অনুযায়ী প্রচলিত ব্যাংক রেটসহ অতিরিক্ত ৫ শতাংশ সুদ দেওয়া হয়নি।
তামাদি পলিসি বাড়ছে ৭০ শতাংশ
কোম্পানির পলিসি তামাদির হারও প্রতি বছর গড়ে ৭০ শতাংশ বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। কোম্পানির বিক্রয়োত্তর সেবা না থাকার কারণে পলিসি তামাদি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী নবায়ন প্রিমিয়াম আসেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
এমএফআই/এএসআর