ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

নারীচালক মিমি

‘অনেক কষ্টে দিন গেছে, এখন ভালো আছি’

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৭ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
‘অনেক কষ্টে দিন গেছে, এখন ভালো আছি’

ঢাকা: বন বিভাগের কর্মচারী বাবা অবসরে গেলেন। এদিকে স্বামীর সংসারেও টানাপড়েন।

ছোট ছোট চার ভাই-বোনকে নিয়ে বাবা কিভাবে চলবেন আর স্বামীর সংসারই বা কিভাবে চলবে? এ ভাবনায় যখন প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন, তখনই এলো নারী ড্রাইভার হিসেবে ব্র্যাকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ‍সুযোগ। দেরি না করে সুযোগটা লুফে নিলেন খুলনার মেয়ে আফসানা মিমি।  

প্রথমে ব্র্যাক ব্যাংক দিয়ে শুরু। এরপর ইউনিসেফ হয়ে এখন তিনি সরকারি চাকুরে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মতো একটি সদা ব্যস্ত প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার (চালক) হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

 

আফসানা মিমি কষ্টের দিনগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কিভাবে দিন পরিবর্তন করেছেন, তা অকপটে বলেছেন বাংলানিউজের কাছে।

নারী ড্রাইভার হিসেবে পেশাগত জীবনের শুরুটা সম্পর্কে আফসানা মিমি বলেন, ‘প্রথমে ২০১২ সালে ব্র্যাকের ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর একই বছরের অক্টোবরে জয়েন করেছিলাম ব্র্যাক ব্যাংকে। সেখানে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ছিলাম। এরপর ৯ নভেম্বর জয়েন করেছিলাম ইউনিসেফে’।
 
‘গত বছরের জানুয়ারিতে ইসিতে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ২০ ডিসেম্বর ফাইনাল রেজাল্ট হয়েছে। ভেরিফিকেশন শেষে গত ০২ মে ইসিতে জয়েন করেছি’।

‘এতো পেশা থাকতে ড্রাইভিং পেশায় কিভাবে এলেন?’- প্রশ্নের জবাবে মিমি বলেন, ‘আসলে এটা ডিফারেন্ট একটা পেশা। মেয়েরা যে সবকিছু করতে পারেন, এটা বোঝাতে। আর আমি যেহেতু গ্রামের মেয়ে, আমি ছোটবেলা থেকেই একটু ভিন্ন। সব সময় কঠিন যে জিনিসটা, সেটা সহজ করে করার চেষ্টা করি। আর আমি একটা অফার পেয়েছিলাম ব্র্যাক থেকে ড্রাইভিংয়ে। আমি বলেছিলাম, যাবো’।

‘পরে ব্র্যাক থেকে যখন শিখলাম যে, আসলে বিষয়টা কি- গাড়ি চালাতে হবে। তখন গেলাম, দেখলাম, যে চেষ্টা করলে সব সম্ভব। মেয়েরা এমনি ঠাণ্ডা মেজাজের, চেষ্টা করলে সবকিছুই পারেন। সেভাবেই মোটামুটি আসা। আমার কাছে প্রথম প্রথম চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে। তারপর মনে হলো যে, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করলে সবই ঠিক, সবার জন্যই’।
 
সরকারি দফতরে প্রথম কোনো নারী ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত আফসানা মিমির বাড়ি খুলনায়। তবে বাবার বাড়ি বাগেরহাটে। খুলনাতেই তারা স্থায়ী হয়েছেন।
 
তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলকাজ উদ্দিন হাওলাদার। তারা তিন বোন, দুই ভাই। মিমি সবার বড়। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েও পরীক্ষা দেননি। তবে এখন আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
 
আফসানা মিমি বলেন, ‘পড়াশোনা বাদ দিয়ে হঠাৎ কর্মজীবনে আসতে হয়েছে পারিবারিক কিছু কারণেই। বাবার অনেক বয়স হয়েছে। তিনি তখন বন বিভাগের চাকরি থেকে কর্মচারী হিসেবে অবসরও নিয়েছেন। এদিকে স্বামীর সংসারেও কষ্ট। তাই বাধ্য হয়েই পড়াশোনা বাদ দিয়ে কর্মজীবনে আসতে হয়েছে’।
 
সাত-আট বছর আগে বিয়ে হযেছে আফসানা মিমির, ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে। স্বামী হাসানুর রহমান খুলনায় ছোটখাট একটা ব্যবসা করতেন। মিমি যখন ইউনিসেফে কাজ করেন, তখন কিছু টাকা জমিয়ে তাকে একটি ফার্মেসি করে দিয়েছেন খুলনার বাজারে। তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসও স্বামীর সঙ্গে খুলনায় থাকে, এখন নার্সারিতে পড়ে। আর তিনি ঢাকায় ‘শতদল’ নামের কোয়ার্টারে একাই থাকেন।
 

ইউনিসেফের চাকরি ছেড়ে সরকারিতে আসার কারণ সম্পর্কে মিমি বলেন, ‘আমি জাতিসংঘের ইউনিসেফে কাজ করেছি। আমি কিন্তু অনেক ভালো একটা চাকরি করতাম। অনেক বেতন ছিল আমার। তারপরও আমি সরকারি চাকরিতে আসছি। কেননা, আমার বাবার অনেক শখ, আমি সরকারি চাকরি করবো। আমি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলাম, যে কখনো ভাবিইনি, সরকারি চাকরি করবো। কিন্তু সরকারি চাকরি যখন হলো, আব্বা বললেন যে, এটা তোমার করতেই হবে। আব্বা বললেন, যে আমি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করছি। এজন্য একটা সার্টিফিকেট পেয়েছি। আর এটা দিয়ে তোমার চাকরি হচ্ছে। কাজেই এ চাকরি তোমার করতেই হবে। এলাকার লোকজনকে বলতে পারবো যে, আমার মেয়েটার আমার সার্টিফিকেটের গুণে চাকরি হয়েছে’।

‘তিনি যেহেতু মুরুব্বি মানুষ, তাই শুধু ওইটাই বুঝেছেন তিনি। আমি তখন বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এটাই করবো’।
 
শ্বশুরবাড়ি থেকে সমস্যা হয় না জানিয়ে আফসানা মিমি বলেন, আমার শ্বশুরবাড়ি অনেক ডিফারেন্ট। তারা খুব পছন্দ করেন যে, তাদের বউ এরকম একটা কাজ করছে। আমার শ্বশুরবাড়ি একটু শিক্ষিত ফ্যামিলি। তারা সব সময় বলেন, কাজ কাজই। খুব সাপোর্ট করেন। তারা সবাইকেই বলেন- আমার বউমা তো গাড়ি চালায়’।

স্বামী-সন্তান ছেড়ে দূরে থাকতে খারাপ লাগলেও আফসানা মিমি বলেন, কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে এটাতো করতেই হবে। এটাতো একটা ভবিষ্যত, আমার বাচ্চার ভবিষ্যত। যে কটা টাকা আয় করছি, তাতে সবাই ভালো থাকবো’। তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় ছিল, আমার স্বামীর আয়-রোজগার ভালো ছিল না। অনেক কষ্টে আমার দিন গেছে। তখনকার চেয়ে এখন অনেক ভালো আছি। তবে চাকরি করলেও কিছুদিন পর পর যাচ্ছি। জয়েন করেই দু’বার যাওয়া হয়ে গেছে। আর আগে তো একসঙ্গেই ছিলাম। এখন পোস্টিং যদি খুলনায় হয়ে যায়, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ’।
 
‘নির্বাচন কমিশনের কাজের পরিবেশ খুব ভালো। বসরাও খুব ভালো। ইউনিসেফেও যেমন বসরা সাপোর্ট করেছেন, এখনাকার বসরাও সাপোর্ট করেন। এখানে সবাই ভাই-বোনের মতো। আমার একটা ভুল হলে সবাই সুন্দর করে বুঝিয়েও দিচ্ছেন’- যোগ করেন মিমি।

আফসানা মিমি সম্পর্কে ইসি’র সচিব সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘নারীচালক হিসেবে ইসিতে মিমিই প্রথম। লিখিত পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্র্যাকটিক্যাল পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই তার যোগ্যতার প্রমাণ মিলেছে। খুব দক্ষতার সঙ্গে সবগুলো বাছাই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে’।

‘একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও বেশ দক্ষতার সঙ্গে আগে মিমি কাজ করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’- যোগ করেন সিরাজুল ইসলাম।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
ইইউডি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।