ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

প্রাণ’র প্রাণপুরুষ আমজাদ খান চৌধুরী স্মরণে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৬
প্রাণ’র প্রাণপুরুষ আমজাদ খান চৌধুরী স্মরণে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: চাকরি জীবন শেষে অবসরের দিনগুলো পরিবারের সঙ্গে কাটবে এটাই ইচ্ছা হয়ে থাকে সবার। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে একটু অরাম আয়েশ করে দিন কাটবে এইতো চাওয়া।

কিন্তু আমজাদ খান চৌধুরীর গল্পটা ভিন্ন। মূলত তার ইচ্ছাটাই ছিলো ভিন্ন কিছু।  

অবসর নিয়ে তিনি বরং কাজে লেগে গেলেন। সেটা ১৯৮১ সাল। অবসর নিলেন, আর দ্রুতই প্রতিষ্ঠা করলেন রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিডেট (আরএফএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কাজ সেচ পাম্প তৈরি। কৃষিপ্রধান দেশে যার প্রয়োজন ছিলো ভীষণ।  

সে কারণেই আরএফএল’র দ্রুত প্রসার হলো। আর ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন পণ্যের তালিকায় যোগ করলো টিউব-ওয়েল, গ্যাস স্টোভসহ আরও কিছু। এক পর্যায়ে আরএফএল হয়ে উঠলো দেশের সবচেয়ে বড় আয়রন ফাউন্ড্রি ও হালকা প্রকৌশল ওয়ার্কশপের নির্মাতা।

১৯৮৫ সালে তার মাথায় এলো নতুন এক পরিকল্পনা। যার নাম প্রাণ। আর দেরি না করে দ্রুতই নরসিংদীতে ছয় একর জমি লিজ নিয়ে নিলেন।

সেই জমিতে চাষ পড়লো পেঁপে, কলা, আনারসসহ আরও কিছু শস্যের। বাজারে এসব ফল-ফলাদি তাজা সরবরাহ করতে লাগলেন। কিন্তু বাজারের ওঠা নামা আছে, রয়েছে আরও কিছু জটিলতা আর সে কারণে প্রায়শঃই ন্যায্য দাম পাওয়া যেতো না।  

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জেনারেলের ব্যবসায়ী বুদ্ধি ততদিনে আরও প্রখর। তিনি বুঝতে পারলেন, কেবল উৎপাদন আর বাজারজাতকরণের মধ্যে নয়, আসলে ফসল উৎপাদন করে তা দিয়ে পণ্য বানিয়ে তাই বাজারে আনতে হবে। অর্থাৎ পণ্য উৎপাদনের পুরো চক্রটিই সম্পন্ন করতে হবে এক হাতে।

যেই ভাবা সেই কাজ। ১৯৯১ সালে আমজাদ খান চৌধুরী শুরু করলেন কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা- প্রাণ। শুরু হলো ক্যানে করে প্রক্রিয়াজাত টুকরো আনারস বিক্রি দিয়ে। পরে সেখান থেকে গেলেন আমের জুস হয়ে জ্যাম জেলি উৎপাদনে। আর তা যে কেবল দেশের বাজারের জন্য, তা নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নজর ছিলো তার।  

প্রাণের পরিকল্পনার দিনগুলোতেই আমজাদ খান চৌধুরী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একদিন বাংলাদেশি কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য থেকে তৈরি খাবার পরিবেশিত হবে ইউরোপের ঘরে ঘরে ডাইনিং টেবিলে। আর সেই লক্ষে পৌঁছাতে তার লাগলো মোটে পাঁচটি বছর। ১৯৯৬ সালে প্রাণ প্রথম রফতানি চালানটি পাঠায় ফ্রান্সে।

২০১০ সালে তার জীবদ্দশায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে খান চৌধুরী বলেছিলেন, সেটাই ছিলো স্বপ্নপূরণ। এরপর রফতানি হতে লাগলো চিনিগুঁড়া চাল, মসলা, আমের জুস ও স্ন্যাকস। এসব পণ্যের প্যাকেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখাটি বাংলাদেশের পতাকার মতো কাজ করেছে।  

বর্তমানে প্রাণ বিশ্বের ১৩০টি দেশে তার পণ্য রপ্তানি করছে, যার মধ্য দিয়ে এর ক্রেতা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি মানুষ। ২০১৩-১৪ সালের হিসেবে প্রাণ-আরএফএল ১৫০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে। ভারতের ডি-মার্ট, যুক্তরাজ্যের উইটকিনসন, কানাডার ডোলারামা, ফ্রান্সের কেয়ারফোর, স্পেনের ইসিআই’র মতো চেইনশপগুলোতে বিক্রি হচ্ছে প্রাণের পণ্য।

প্রাণের সাফল্যর ধারায় প্রাণ হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান আর আমজাদ খান চৌধূরী হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প উদ্যোক্তা।

মানব সভ্যতা কোনও কালেই কৃষিকে এড়িয়ে সামনে এগুতে পারেনি, এমনটাই বিশ্বাস করতেন আমজাদ চৌধুরী। ২০১১ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকে নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে টিকে থাকতে কৃষি উৎপাদনে আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। আর সে লক্ষ্যে আমরা কৃষি পণ্য উৎপাদন বাড়ানো আর পাশাপাশি কৃষিকেই কর্পোরেটাইজড করতে চাই।

এছাড়াও খান চৌধুরী চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের একটি বিপ্লব দেশব্যাপী ঘটিয়ে ফেলেন। সারা দেশের ১ লক্ষ শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।  

এর ফল ছিলো অবস্যম্ভাবী আর পুরস্কারমূলক। আমজাদ খান চৌধুরীর ভাষায়, এতে কৃষকরাই উপকৃত হলেন বেশি, আর একই সঙ্গে উপকার পেলেন কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীরা।  

ইংরেজি দৈনিকর ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, চলতি বাজার দরের মধ্যে থাকায় পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হলো না। আর এর মধ্য দিয়ে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও চুক্তিবদ্ধ উৎপাদকদের মধ্যে যে সেতু বন্ধন রচিত হলো তা দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো সম্মৃদ্ধির পথে।

দেশে দুগ্ধজাত পণ্যের শিল্পে তখনও বড় কোনও অগ্রগতি ছিলো না। সেদিকেও আমজাদ খান চৌধুরী তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।  প্রাণ ডেইরি প্রতিষ্ঠা করে তিনি বড় অংকের বিনিয়োগ করলেন যাতে কৃষকরা আরও বেশি করে দুধ উৎপাদন করতে পারে। আর তা হবে প্রতিটি পশুর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার মধ্য দিয়ে।  

প্রাণ ডেইরির ওপর ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখেছে, গ্রাম বাংলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির এ ছিলো এক আন্তর্জাতিক মানের সাফল্য।  

দুই দফায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাচিত সভাপতি ও সফল এই ব্যবসায়ী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, যে কোনও উন্নয়ন পরিকল্পনাই গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। কারণ এর মধ্য দিয়েই দেশের মানুষের একটি বড় অংশকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়।  

এখন প্রাণের সরাসরি নিযুক্ত কর্মী সংখ্যা ৮০ হাজার। পরোক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছেন আরও দুই লাখ মানুষ। আর তাদের সূত্র ধরে ১৫ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হচ্ছে প্রাণের উদ্যোগে।  

জীবদ্দশায় এই প্রচেষ্টায় একদণ্ডের জন্যও বিরতি দেন নি আমজাদ খান চৌধুরী। তার মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, ভবিষ্যতমুখী মানুষের উদাহরণ। জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে তিনি দেশের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন।

২০১৫ সালের ৮ জুলাই ৭৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আমজাদ খান চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।