ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

এসএমই ঋণে বিপাকে নারী উদ্যোক্তারা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
এসএমই ঋণে বিপাকে নারী উদ্যোক্তারা লোগো

ঢাকা: শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকে সংক্ষেপে এসএমই খাত বলে বিবেচনা করা হয়। তবে দেশের সরকারি ব্যাংক থেকে আরম্ভ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের সময়মত এসএমই ঋণ দিচ্ছে না। দেখাচ্ছে নানান রকমের অজুহাত, করছে হয়রানিও।

ঋণ দেয়া হলে আবার নারী উদ্যোক্তাদের কাজ থেকে নেয়া হয় বেশি সুদ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রয়াত্ত সরকারি সোনালী ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতে ঋণের উপর ১৩ শতাংশ হারের বেশি সুদ নেয়।

আর পুরুষ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে সুদ নেয় বলে অভিযোগ করেন উদ্যোক্তারা।

উদ্যোক্তাদের কম সুদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ঋণ দিতে বাংলাদেশ বাংকের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাংক উচ্চহারে সুদ নিয়ে ঋণ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে স্প্রেড ৫ শতাংশের বেশি। রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে গড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিচ্ছে গড়ে ১৫ শতাংশ বা তারও বেশি। আর ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ হারে।

উদ্যোক্তারা অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে এসএমই ব্যাংক খাতের ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান (স্প্রেড) সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এরপরেও বেশিরভাগ ব্যাংক এখনও পযন্ত এসএমই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুদ (১২ থেকে ১৩ শতাংশ) আদায় করছে। রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংক পুরুষদের এসএমই খাতে ঋণের ওপর ১২ শতাংশ সুদ নেয় এবং নারীদের ক্ষেত্রে সুদ নেয় ১৩ শতাংশের বেশি।

মেসার্স এম এইচ কে পোল্ট্রি ফার্ম প্রোপ্রাইটার এবং উদ্যোক্তা উম্মে কুলসুম বলেন, ‘‘ব্যাংক এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে এত বেশি শর্ত (কন্ডিশন) দেয় যে, গ্রাহক বা আমাদের মতো নারী উদ্যোক্তারা সহজে এমএমই ঋণ নিতে পারেন না। তাদের কমিশনগুলো বা শর্তগুলো পূরণ করে এসএমই ঋণ নেয়াটা যে কোনো উদ্যোক্তার পক্ষে অনেক কঠিন। তাছাড়া, সিঙ্গেল ডিজিট ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো ব্যাংকই তা দিচ্ছে না।

এদিকে বাংলাদেশ বিউটি পার্লার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদা মোস্তাকিমা রুবি অভিযোগ করেন, ‘‘এসএমই ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় নারীদের। ব্যাংক কর্মকর্তারা স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে চান না। এর ফলে আমাদের মত অনেক নারী উদ্যোক্তা হতাশ হয়ে ব্যবসা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বা যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ের প্রসারতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এসএমই খাতে স্বল্প সুদে নারীদের ঋণ দেয়ার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এমএমই ঋণের নামে নারীদের আরো বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। ’’

রাজশাহী উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-র সভাপতি রস্তি নাজনীন বলেন, ‘‘রাজধানীর বাহিরে নারী উদ্যোক্তাদের এসএমই ঋণ পাওয়াটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের। কারণ ব্যাংকগুলো আমাদের বিশ্বাসই করতে চায় না। কখনো সখনো যদিওবা ঋণ দেয়, সেটা দেয় অত্যন্ত চড়া সুদে। ফলে বিপাকে পড়তে হয় আমাদের মত নারী উদ্যোক্তাদের। ’’

এদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে সবোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এ-প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের কাজ হলো এসএমই খাতকে এগিয়ে নেওয়া। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভবিষ্যৎ। তাছাড়া এসএমই খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ভূমিকাই হলো অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার সমর্থন করা এবং জিডিপি হার বাড়ানো। ’’
 
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় কাজ হবে এসএসই খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সাহসী হতে হবে। এ-খাতে সাহসিকতার বিকল্প নেই। ২০১২ সালে ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির পর তারা (ব্যাংকগুলো) ঋণ দিতে ভয় পেত। আমি তখন গ্রহীতাদের ঋণ দেওয়ার কথা বলেছি। পাশাপাশি মনিটরিং বাড়ানোর কথাও বলেছি। ’’

তিনি বলেন ‘‘ঋণ নেওয়ার যে নিয়মকানুন আছে সে সম্পর্কে গ্রহীতাদের জানতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নারীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যাংকের মনিটরিং আরো জোরদার করা হচ্ছে। আর নারীদের এসএমই ঋণের ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। অন্য ব্যাংকগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা হবে। ’’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস.কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘‘সকল ক্ষেত্রেই স্কিল ডেভেলপমেন্টের বিকল্প নেই। গত ৩ বছরে এসএমই খাতে ১০ লক্ষ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। আবার স্কিল ফর ইমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট (এসইআইপি) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ করাতে হবে। ’’

এসএমই ও গ্রিন ব্যাংকিং খাতে ৪ লক্ষ কোটি টাকা এ পযন্ত বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এর পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে এমএমই ঋণ দেয়ার ব্যাপারে বেসরকারি-সরকারি ব্যাংকগুলোর উপর তদারকি বাড়ানো হয়েছে।  

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সভাপতি  আবুল কাসেম খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘২০১৭ সালে ঢাকা চেম্বারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এসএমই খাতের উন্নয়ন, জ্বালানি, ঢাকা চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোর, ট্যাক্স, ভ্যাট এবং অন্যান্য কর, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, গবেষণা ও উন্নয়ন, নতুন উদ্যোক্তা তৈরিকরণ প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন ও পাটপণ্য বহুমুখীকরণ। ’’
 তিনি বলেন, ‘‘দেশের প্রথম সারির উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হলো ব্যাংকের এসএমই ঋণ। সঠিক সময়ে ব্যাংক থেকে কম সুদে এসএমই ঋণ না পেলে তাদের ব্যবসায়ের আওতা সংকুচিত হয়ে যাবে। স্বল্পসুদে ঋণ না পেলে সহজে কোনো উদ্যোক্তা ব্যবসায়ে হাত দেবেন না। তবে এমএমই ঋণে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সমুখীন হচ্ছেন দেশের নারী উদ্যোক্তারা। দেশের সরকারি ব্যাংকের সাথে সাথে প্রাইভেট ব্যাংকগুলো তাদের এমএসই ঋণের সুদ কমিয়ে আনলে দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবেন। সুন্দর একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ’’ 

এ ব্যাপারে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহম্মাদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের এসএমই সম্ভাবনাময় খাত হওয়ার সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেটি গড়ে ওঠেনি। তবে ব্যক্তি-উদ্যোগে যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা দেশে বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোর ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ এসএমই খাতের অন্তর্ভূক্ত। আর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের এসএমই খাতের প্রধান সমস্যা হলো অর্থায়ন। এই এসএমই অর্থায়ন-ঋণে আবার নারীদের বেলায় সুদের হার অনেক বেশি। এতে করে দেশে নতুন নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি না হয়ে বরং উদ্যোক্তাদের বিনাশই ঘটছে। তাই সরকারিভাবে এসএমই খাতের ঋণ নিয়ে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। যাতে করে এসব উদ্যোক্তা নিজেদের ব্যবসা সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এজন্য দরকার এসএমই খাতে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা ও তা ববাস্তবায়ন করা। ’’


বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
ওএফ/জেএম

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।