ঢাকা: নতুন বাজার সৃষ্টি ও পণ্যের পরিচিতি এবং এসএমইএ খাতের অন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য, বাজারজাত কৌশল ও পণ্যমানের দক্ষতার বিনিময়ের লক্ষ্য নিয়ে উদ্যোক্তাদের মিলন মেলা চলছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রে। মেলায় সারাদেশ থেকে আসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ পণ্য তুলে ধরছে।
এবারের মেলায় ৩২৫ প্রতিষ্ঠানের ৩৫১টি স্টল রয়েছে। এ সব স্টলে পণ্যের পাশাপাশি এসএমই খাতের উদ্যোক্তার মাঝে ঋণ বিতরণকারী ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এসএমই খাতের সহায়তা দেওয়ার সরকারের বিটাকের মতো সেবা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
মেলায় এসএমই ফাউন্ডেশনের অফিস জানায়, করোনা মহামারি পরবর্তী এবারের মেলা কোনো বিধি-নিষেধ ছাড়াই মুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ কারণে অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠান, স্টল সংখ্যা এবং মেলায় ঘুরতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর ১১কোটি টাকার পণ্য বিক্রি ও ১০ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ পাওয়া গিয়েছিল, এবার তা দ্বিগুন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গত বছর মেলা হয়েছে এক সপ্তাহ। এবার মেলা চলবে ১০দিন। উদ্যোক্তাদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে।
মেলার দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্যোক্তারা নিজ নিজ পণ্য দেশজুড়ে ছাড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ক্রেতা ও দর্শনার্থী আসলেই তুলে ধরছেন পণ্যের গুণাগুণ। কুমিল্লা থেকে আসা পূর্বাশা গিফ্ট অ্যান্ড খাদির নির্বাহী পরিচালক ফাতেমা ইসলাম তাদেরই একজন।
বাংলানিউজকে জানান, সরাসরি ও অনলাইনের মাধ্যেম প্রায় সারাদেশে তাদের পণ্য বিক্রি হয়। এই মেলার মাধ্যমে বাজারকে আরও প্রসারিত করতে চান। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের খাদির বিভিন্ন নিজস্ব ডিজাইনের পোশাক বিক্রি করেন।
সারাদেশে ফাতেমার ১২টি শোরুম ও দোকান রয়েছে। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি এসব দোকানের মাধ্যমে পোশাক বিক্রি হয়। তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ২০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। চুক্তিভিত্তিতে আরও প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ আছে, যারা চাহিদা মতো পণ্য সরবারহ ও খণ্ডকালিন কাজ করেন।
এসএমই খাত দেশের কর্মসংস্থানের প্রধান জায়গা। কিন্তু নানান সমস্যার কারণে এ খাত যেভাবে ভূমিকা রাখার দরকার ছিল, সেভাবে পারছে না, এ অভিযোগ এসএমই ফাউন্ডেশনেরও। বাজারজাত ও পুঁজির অভাব এ খাতের প্রধান সমস্যা। অনেকে নিজ উদ্যোগে শুরু করেন, কিন্তু পুঁজির অভাব এবং বাজারজাত সমস্যার কারণে বেশিদূর আগাতে পারেন না। ব্যাংকও নানারকম ডকুমন্টে ও জামানত না থাকলে ঋণ দেয় না। ফলে বেশির ভাগ উদ্যোগই আলোর মুখ দেখার আগে মারা যায়। এসএমই মেলার কমপক্ষে পাঁচজন অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তা ব্যাংকের এমন অসহযোগিতার কথা জানান।
এ বিষয়ে মেলায় অংশ নেওয়া চাপাইনবাবগঞ্জের চাঁপাই নকশী কথার ম্যানেজার এবং প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোসা. আইরিন খানের বাবা এনামুল হক বাংলানিউজকে জানান, নিজেদের উদ্যোগে জেলার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রায় আট হাজার নারীর কর্মসংস্থান করেছেন। যারা সবাই দরিদ্র, প্রান্তিক নারী। নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও ব্যবসা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হচ্ছে। ব্যাংকে গেলে ঋণ দিচ্ছে না। আইরিন বা তার বাবার মর্ডগেজ দেওয়ার মতো জমি নেই- একথা শুনলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ব্যবসা দেখতে যাব-যাচ্ছি বললেও যাচ্ছে না, ঋণও দিচ্ছে না।
আইরিন ফেসবুক ও মোবাইল ব্যবহার করে নকশীকাঁথার মার্কেটিং করেন। নকশীকাঁথা বিক্রির পরিধি আরও বাড়াতে চান এসএমই মেলার মাধ্যমে। গতবার নতুন অর্ডার ও ক্রেতা পেয়েছিলেন, এবার মেলাতেও নতুন ক্রেতা পাওয়ার আশা করছেন তিনি।
এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে অভিযোগের ভিন্ন কথাও বললেন উদ্যোক্তা ফাতেমা ইসলাম। তিনি বলেন, অধিকাংশ উদ্যোক্তা ব্যবসার সঠিক হিসাব রাখলেও এবং ব্যবসায় টাকার লেনদেন করলেও ব্যাংকের ধারে কাছে যায় না। হঠাৎ করে ব্যাংকে গেলে তারা ঋণ দেয় না। আরও একটি সমস্যা হলো অনেকে ব্যবসা করলেই সঠিক হিসাব করে না, ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে না। এই ভীতি থেকে ব্যাংক ঋণ পায় না।
এসএমই খাতের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো আর্থিক সমস্যা। তারা পুঁজি পান না। এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ট্রেনিং ও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া। তার অংশ হিসাবেই এই মেলা বলে জানান এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মেলায় এসে পণ্যের গুণাগুণ, বাজারজাত কৌশল যেমন জানতে পারবে, উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের কৌশলও রপ্ত করবে। এ জন্য ১১ ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্টলের ব্যবস্থা হয়েছে। এ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারা কথা বলবে। নিজেদের ব্যবসার ধরণ, দক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে।
মেলায় বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকের দুই স্টলে দুই ধরনের কথা বললেন সংশ্লিস্ট দুই কর্মকর্তা। কৃষি ব্যাংকের প্রতিনিধি বললেন, ঋণ দেই। ট্রেড লাইসেন্স, স্বামী বা স্ত্রী এবং তৃতীয় একজন জামিনদার লাগে। এছাড়া ঋণের নিরাপত্তার জন্য মর্ডগেজ লাগে। ব্র্যাক ব্যাংকের স্টলে থাকা একজন জানান নির্দিষ্ট অংকের টাকা পর্যন্ত কোনো মর্ডগেজ লাগে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চুক্তিপত্র, ব্যবসার কাগজপত্র ও জামিনদার পেলেই ঋণ দেওয়া হয়। কেউ ঋণ চাইলে তাকে গুলশান শাখায় পাঠানোর অনুরোধ করেন ব্র্যাক ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।
এসএমই মেলাতে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স সেন্টারের (বিটাক) মত সরকারি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। কেউ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্পেয়ার পার্টসের তৈরি কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে এখান থেকে সহায়তা নিতে পারে। বিটাক ফি নিয়ে ও ফ্রি দুই ধরনের প্রশিক্ষণই দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ঘণ্টা, ২৫ নভেম্বর , ২০২২
জেডএ/এমএমজেড