ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সম্পাদকীয়

গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া

মন্ত্রী তাঁর কথা রাখুন, ভাড়া-জুলুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫
মন্ত্রী তাঁর কথা রাখুন, ভাড়া-জুলুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

গত ২৭ আগস্ট সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর গত ১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তা কার্যকর হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে গেছে ভাড়া-নৈরাজ্য। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো গণপরিবহনে শুরু হয়ে গেছে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া আদায়।

কোনো সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা ছাড়াই এক তরফা। এনিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডাসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। এসবের মধ্যে আছে বাস থেকে যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেওয়া, অশোভন ব্যবহার, বক্রোক্তি, অশ্লীল বাক্য ব্যবহার, এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত।

জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে—এ আর বিচিত্র কী! এনিয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। কিন্তু কতটুকু বাড়বে সেটা তো আগে নির্ধারিত হওয়া দরকার। পরিবহনের ভাড়া সমন্বয়টা তো জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের  সাথে সঙ্গতি রেখেই করতে হবে। এ নিয়ে দুটো আলাদা কমিটিও হয়েছে। তারা আগামী ৫ থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৈঠক করে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে দেবেন। কিন্তু তার আগেই যার-যেমন-খুশি বাড়তি ভাড়া আদায়ের সুযোগ নেই। নেই যুক্তিও। কিন্তু যুক্তির তোয়াক্কা করছেন না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।
 
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার নিজ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি কড়া হুঁশিয়ারি দেন: ‘ভাড়ার হার নির্ধারণের আগেই বেশি ভাড়া আদায় করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

মন্ত্রী যখন এই হুঁশিয়ারি দিলেন তার আগেই গণপরিবহনে শুরু হয়ে গেছে বাড়তি ভাড়া আদায়। যার যেমন খুশি। যাত্রীদের আর্থিক ভোগান্তি বেড়ে যাওয়া, যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি, বচসা এমনকি যাত্রী-লাঞ্ছনা ও হাতাহাতির এসব ঘটনা বড়ই দু:খজনক।  

‘আপাতত আগের হারেই ভাড়া কার্যকর থাকবে’ এবং  ‘নির্ধারণের আগেই বেশি ভাড়া আদায় করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’—মন্ত্রীর এই ঘোষণা মঙ্গলবার যেমন, আজ বুধবারও কোনো কাজেই আসেনি। তার হুঁশিয়ারি আগের অনেক হুঁশিয়ারির মতো স্রেফ কথার কথাই থেকে গেছে।

সড়কমন্ত্রীর এমন হুঁশিয়ারি নতুন নয়। এর আগেও তিনি ‘মেয়াদ-উত্তীর্ণ ফিটনেসহীন যানবাহন মে মাসের পর আর চলতে দেওয়া হবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরের রাস্তায় এই সেপ্টেম্বর মাসেও ফিটনেসহীন লক্করমার্কা যানবাহন ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায় দিব্যি চলছে। এই বৃষ্টিবাদলার দিনেও চলছে। রাজধানীতে ছাদ-ফুটো-হয়ে-যাওয়া, জানালার কাচ-না-থাকা অনেক বাস  ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায় অবাধে চলাচল করছে। সংশ্লিষ্টদের এ-নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ছাদ-ফুটো বাসে যাতায়াতের সময় অঝোর বৃষ্টির সময় এ যাত্রীরা ভিজে একশা হচ্ছেন কিন্তু কারোরই টনক নড়ছে না। পুলিশ কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তারা বাসের মালিক-শ্রমিকদের কাছ থেকে টু-পাইস কামাবার মওকা পেয়েই যেন খুশি! যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতেও তাদের কিছু যায়ও না, আসেও না।  

লক্কর মার্কা বাসসহ যাত্রীবাহী যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে দেবার সদম্ভ ঘোষণাটি বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি; ভাড়ার ব্যাপারে মন্ত্রীর সর্বশেষ এই হুঁশিয়ারিটিও যে শেষপর্যন্ত স্রেফ কথার কথা হয়েই থাকবে—সেটা আঁচ সবাই আঁচ করতে পারেন। যেকথা রাখা যাবে না, সেকথা শোনানোরও কোনো মানে নেই তাহলে!
 
মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানালেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সিএনজিচালিত গণপরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে সরকারের গঠিত কমিটি আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসবে। একটি কমিটি বাস-মিনিবাসের ব্যয় বিশ্লেষণ করে এর ভাড়া নির্ধারণ করবে। অন্য কমিটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলরত সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া প্রস্তাব করবে।
 
মন্ত্রী আরও জানান, পরিবহন মালিক সমিতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণের জন্য চিঠি দিয়েছে। কিন্তু দুটি কমিটির সুপারিশের আগে ভাড়ার হার বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। অতএব, এখন বাড়তি ভাড়া আদায় করাও যাবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই কমিটিতে কারা আছেন? একটি জাতীয় দৈনিক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে, বাস-মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ তৈরি করে ১২ সদস্যের কমিটি। অটোরিকশার ভাড়া পুনর্নির্ধারণে আট সদস্যের আরেকটি কমিটি আছে। তবে কোনো কমিটিতেই যাত্রীদের প্রতিনিধি নেই।

যারা প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হন, বাড়তি ভাড়া গুনে গুনে যারা হয়রান, গন্তব্যে পৌঁছতে যাদের প্রতিদিন নাভিশ্বাস ওঠে, পথে পথে যারা লাঞ্ছিত হন, যানজটে রাস্তায় নাকাল হন, সেই যাত্রীসাধারণের পক্ষের প্রতিনিধি নেই কেন? না থাকবার যুক্তিটা কি? সরকার কার কথা শুনবে? কেবলই কি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কথা?  
 
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক মঙ্গলবার সখেদে বলেছেন, 'আগে আমাদের রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরিবহন মালিকদের চাপে পরে আমাদের বাদ দেওয়া হয়। '
আমরা মনে করি, যাত্রীদের প্রতিনিধিদের দূরে সরিয়ে কেবল এক পক্ষের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে ন্যায়সঙ্গত হবে না।  

ভাড়াবৃদ্ধির কারণে নাজেহাল হবার অনেক ঘটনাই ভূক্তভোগী যাত্রীরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেছেন/ধরছেন  কাল ও আজ। কেউ কেউ ভিডিওসহ। এর মধ্যে সাধারণ ছাপোষা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন অনেক সেলিব্রেটিও। দৈব চয়নের মাধ্যমে আমরা এরকম একজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি তাঁরই নিজের জবানে। তাঁর অভিজ্ঞতাটি অবশ্য সাধারণ বাসযাত্রীদের অভিজ্ঞতার মতো ততোটা দু:খজনক বা বিব্রতকর নয়। তিনি এ-সময়ের স্বনামধন্য কথাশিল্পী মঈনুল হাসান সাবের। তার স্ট্যাটাসটা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো:
 
‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি চালিত বাস ও অটোরিকশা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, শুনেছি। এ নিয়ে নানা নৈরাজ্য, নানা ঝামেলা চলছে, তাও শুনেছি। আজ যখন বাসা থেকে বের হলাম, মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বের হলাম যে, বেশি ভাড়া গুনতে হবে। কোনোরকমে একটা অটোরিকশা থামানো গেল। যেখানে যাব, ভাড়া এতদিন দিয়েছি ২০০। ধারণা করলাম আজ ৩০০ দিতে হবে। অটো চালক এদিকওদিক তাকিয়ে নিয়ে বললেন, স্যার, দেড়শ দিয়েন। আমি অবাক গলায় বলেই ফেললাম, মানে? আপনারা নাকি ভাড়া বাড়িয়েছেন।

অটোচালককে দেখে মনে হলো ভয়ে গুটিয়ে গেছে। এবার ফিসফিস করে বলল, কেন স্যার, শোনেননি, মন্ত্রী ওবায়দুল বলেছেন, নির্ধারণের আগেই বাড়তি ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেবেন। ’

আমরাও চাই মন্ত্রী যেন ভাড়া-জুলুমের বিরুদ্ধে শুধু কথা না বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।

আমরা চাই জনগণের প্রতিনিধিরা যেন জনগণের দু:খটা বোঝেন, তাদের ভোগান্তি কমানোর ব্যবস্থা করেন এবং গণপরিবহন ব্যবস্থায় চলমান নৈরাজ্যের অবসানে সত্যি সত্যিই ভূমিকা রাখেন। স্রেফ কথার ফুলঝুরিতে জনগণকে ‘ফুল’ বা ‘বোকা’ বানানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। কথা ও কাজের ফারাক না ঘুচলে জনগণের দুর্দশাও কমবে না। আমরা আশা করতে চাই, মন্ত্রী এবার অন্তত তাঁর কথা রাখবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।