ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সম্পাদকীয়

বর্ষশেষ: বিশ্বের তুহীন ভেঙে উড়ুক সোনার প্রজাপতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
বর্ষশেষ: বিশ্বের তুহীন ভেঙে উড়ুক সোনার প্রজাপতি বিশ্বের তুহীন ভেঙে উড়ুক সোনার প্রজাপতি

আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধদীর্ণ একটি বছর ২০১৬ সাল। আর স্বদেশে? হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় খুন-বর্বরতা আর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার কালিমালিপ্ত বছর এটি। এর জের ধরে সাঁড়াশি জঙ্গিদমন। ধর্মান্ধ জঙ্গিদের আস্তানায় চালানো হয়েছে দমন-অভিযান।

কোনো বছরই নিরবচ্ছিন্ন ভালো বা মন্দ হয় না। ২০১৬ সালটাও তাই।

বিয়োগান্তক ঘটনার যেমন কমতি ছিল না, তেমনি কমতি ছিল না আশাপ্রদ ঘটনারও। বাংলাদেশে বছরটি ছিল ‘জঙ্গি দমনের বছর’। এ বছর জঙ্গিবিরোধী সংকল্পের প্রবলতম নজির সৃষ্টি করেছে সরকার। কম করেও ৮টি অভিযান। ৩৬ জনের বেশি জঙ্গি অক্কা পেয়েছে তাতে। আটকও হয়েছে আত্মঘাতী নারী-জঙ্গি সহ বহু ভয়ঙ্কর জঙ্গি।

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্যের মর্যাদাভূষিত। নব্য অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পেয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে বড় বিনিয়োগচুক্তিও হয় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সফরকালে।

এছাড়া পদ্মাসেতুর কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ফ্লাইওভারের কাজসহ যোগাযোগখাতে বেশকিছু অগ্রগতিও ঘটেছে এবছর। এই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। হয়েছে দুদককে কিছুটা ঢেলে সাজানোর কাজও। সংস্থাটির সক্ষমতা বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাস-হস্তক্ষেপহীন শান্তিপূর্ণ, ইতিবাচক নির্বাচন  নির্বাচনী সংস্কৃতিতে বইয়ে দিয়েছে কিছুটা সুবাতাস। নেতিবাচক রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিএনপি। তারা এবার সংলাপমুখি হয়েছে।

বিদ্যুৎখাতসহ বেশ কিছু খাতে অগ্রগতি হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্মানের আসনে আসীন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা জীবিত ও প্রয়াত অনেক বিদেশি বন্ধু পেয়েছেন পদক ও সম্মাননা।

২০১৬ সালটি ছিল জ্বালাও-পোড়াওহীন, আগুন-বোমা-সন্ত্রাসহীন রাজনীতির বছর। মৎস্য, বিশেষ করে ইলিশের বাম্পার  উৎপাদন ও আহরণের বছর ছিল এটি। প্রজননকালে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার ফলে ইলিশ উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। পুষ্টি ও প্রোটিনের যোগানে এটা রেখেছে বড় ভূমিকা।

ইতিবাচকতার পাশাপাশি নেতিবাচক অনেক ঘটনাও ঘটেছে বছরজুড়ে। যেসব ঘটনা আমাদের স্তব্ধ-ব্যথিত ও বিমর্ষ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, সাঁওতাল জনগোষ্ঠির ওপর হামলা ও তাদের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়ণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু ও দরিদ্রদের ওপর হামলা লুটপাট, বহু স্থানে প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়ি ও জমি দখল, কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে ও রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশাকে প্রকাশ্যে খুন, ছাত্রলীগকর্মীদের বহুবিধ ন্যক্কারজনক কাজ সহ বেশ কিছু নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালে। আমাদের অর্জনের মুখে কালি লেপে দিয়েছে এসব।

বছর শেষে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনাটি ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে মানবসৃষ্ট ত্রুটির ঘটনা। ঘটে যেতে পারতো মর্মান্তিক ট্রাজেডি। ‘এর পেছনে আসল রহস্য কি?’ --- এপ্রশ্নের জবাব হয়তো জমা  ২০১৭ সালের গর্ভে। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও প্রাণভয়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত  চ্যালেঞ্জ।

আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘটেছে কতো না ঘটনা-দুর্ঘটনা। সিরিয়াযুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়, বিশ্বের নানা শহরে আত্মঘাতী হামলা, রুশ সামরিক বিমানের সমুদ্রে আছড়ে পড়ার ঘটনাসহ বেশ কটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এ বছর। দক্ষিণ চীনসাগরে বেড়েছে চীন-মার্কিন উত্তেজনা। ন্যাটো-যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সঙ্গে বেড়েছে রাশিয়ার বৈরিতা। বিশেষ করে পুতিন-ওবামার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব পেয়েছে নতুন মাত্রা। হ্যাকিং এরই একটা অছিলামাত্র।

অন্য দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার আগমনীর। রুশ-মার্কিন বৈরিতা হাজির হতে পারে অভাবিতপূর্ব এক রুশ-মার্কিন মিত্রতার রূপে।

এছাড়া ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের হটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন নিজের হাতে। রাশিয়া ফিরে পেয়েছে তার হারানো সামরিক-রাজনৈতিক পরাশক্তির স্ট্যাটাস। দুনিয়া এখন কাঁপছে পুতিনজ্বরে।

রক্ত-অশ্রুর সীমাহীন পথ পেরিয়েছে ২০১৬ সালের প্রতিটি সূর্য। পেরিয়েছে অনেক আগুন আর গন্ধকের নদী। পিছে ফেলে এসেছে বিপজ্জনক বারুদ-পরিখা। এসবেরই চিহ্ন লেগে আছে এর শরীরে। এবার বিদায় নেবে সে। মহাকালের দিগন্তের ওপারে ঘাড় নুইয়ে ডুবে যাবে সে চিরতরে।

ইত্যবসরে মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে সম্পর্কে জমেছে কতো না বরফ। তেমনি বরফ গলেছেও অনেক। ধূসরতার ভেতর থেকে উঁকিও তো  দিয়েছে অনেক সূর্যঝিলিক। কি আছে ২০১৭ সাল নামের সান্তাক্রসের উপহারের ঝুলিতে?  আমরা জানি না। তবে আমরা প্রস্তুত। ভালোমন্দ যা-ই আসুক। বুক পেতে নেবো। আশায় বুক বেঁধে শুধু বলি: বিশ্বের তুহীন ভেঙে উড়ুক সোনার প্রজাপতি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬

জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।