ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সম্পাদকীয়

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হোক তারুণ্যের উজ্জীবনমন্ত্র

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৭
 ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হোক তারুণ্যের উজ্জীবনমন্ত্র ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা ‘বিশেষ সম্পাদকীয়’

‘পহেলা বৈশাখ মানেই ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ-ভুলিয়ে-দেওয়া অসাম্প্রদায়িকতার  আর বাঙালিয়ানার জয়গান। সর্বজনীন উত্সব উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলার সব মানুষের এক হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করা। পহেলা বাঙালি- সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা উপকরণ, রঙ-বেরঙের মুখোশ, শাড়ি, ধুতি আর পাঞ্জাবির মতো বাঙালি-সাজে নিজেকে সাজিয়ে, রাঙিয়ে ঘুরে বেড়ানো। তবে এই দিনের আয়োজনে সবচেয়ে বড় আকর্ষণটাই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্বঐতিহ্যের অংশ।

ইউনেস্কো-ঘোষিত ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’। গত বাংলা নববর্ষে ঘোষণা করা হয়েছিল বিশেষ উৎসব-বোনাসও। আর আসন্ন নববর্ষটি পেতে চলেছে নবতর এক মাত্রা ও ব্যাপকতা। দেশের সব স্কুল-কলেজে মহাধুমধামে বর্ষবরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মহাউদযাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন বাধ্যতামূলক করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। বড়ই ইতিবাচক এই ঘোষণা।
 
এর বহু আগে প্রতিবছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাদোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান হতো। একে ঘিরে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে। নাগরিক আবহে সর্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
 
এরপর এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে পহেলা বৈশাখের সকালে সর্বপ্রথম একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করেন।

এ-শোভাযাত্রা সে-বছর ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। তবে শুরুতে শোভাযাত্রাটির নাম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' ছিল না। তখন এর নাম ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রাই সারাদেশে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। যে উত্সব বরিশাল ও ময়মনসিংহ শহর হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়ে গেছে। এরপর থেকে এটি হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন আনন্দ শোভাযাত্রা।
 
প্রথম শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ ছিল বিশালকায় পুতুল, হাতি, কুমীর ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মোটিফ------মুখোশ-সাজসজ্জ ও বাদ্যযন্ত্রসহ বিপুৃল নৃত্যগীতমুখরতা।
 
আইডিয়াটার উদগাতা অবশ্য যশোরের চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ সালে তারা খুব বর্ণিল একটি শোভাযাত্রা বের করেছিল রাজপথে। বাঙালি কেতার নানা রকম বাহারি পোশাক আর উপকরণ দিয়ে সাজানো গোছানো এ শোভাযাত্রা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল তখন। এর উদ্যোক্তা ছিলেন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চারুপীঠ’-এর প্রতিষ্ঠাতা তরুণ শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম, হিরন্ময় চন্দ ও ছোট শামীমসহ কয়েকজন।
 
মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাধ্যতামূলক করে মাউশি-র বর্তমান এই ঘোষণাটি এমন এক সময়ে এল, যখন মূর্তিমান অসুরের মতো উদ্যত জঙ্গিবাদ। উগ্রবাদ আঘাত করে চলেছে আমাদের নানাবিধ অর্জনকে। যখন আমরা রক্তপাত-হিংসা, বোমা-গুলির তাণ্ডবে অতীষ্ঠ। যখন প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যার বর্বরতা চলছে; কিশোর-তরুণদের ধর্মের নামে মানুষহত্যায় নামানো হচ্ছে। বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের ‘নরককুণ্ড’ বানাতে চাচ্ছে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। যখন ঘটে গেছে একের পর এক প্রগতিশীল তরুণ-লেখক-প্রকাশক-ব্লগারদের প্রকাশ্য ও গুপ্ত হত্যা। যখন ঘটানো হয়েছে হলি আর্টিজানের মতো বীভৎস ঘটনা। এসব ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক তাণ্ডবে বিপথগামী তরুণদের ক্রীড়ণক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে/হচ্ছে ।
 
এর আগেও আমরা দেখেছি ‘‘বাংলা হবে আফগান’’ বলে ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রকাশ্য আস্ফালন। এরা নারীদের শিক্ষা ও চাকরির ও শিল্প-সংস্কৃতিসহ যাবতীয় সুকুমারবৃত্তির বিরোধী। সরকারের ওপর চাপ দিয়ে এরা পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলতে চাইছে। এর কিছু অশুভ আলামতও দেখা গেছে। আদালতপ্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায়ের প্রতীক যে ভাস্কর্য, সেটিও অপসারণের আলটিমেটাম দিয়ে বসে আছে এরা। সব মিলিয়ে অশুভের আস্ফালনে-আক্রমণে জর্জরিত আমরা।
 
এখন আমাদের প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এক কাতারে দাঁড়ানো। কেননা যখন বাঙালি কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে এক কাতারে দাঁড়ায় তখনই সে অদম্য, অজেয়। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান এমনকি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী মহা-আন্দোলন এর জ্বলন্ত সাক্ষী। মঙ্গল শোভাযাত্রা কূপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে আমাদের একাট্টা হবার প্রেরণা যোগাবে। দেশের লাখো লাখো তরুণ সত্যিকারের মহা-উৎসবের, ফিয়েস্তার, কার্নিভালের, মেগা-উৎসবের আনন্দের অংশীদার হতে পারবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সে সুযোগ এনে দেবে। লাতিন আমেরিকায় যেমন সাম্বা।
 

গোটা দেশজুড়ে যখন এই শোভাযাত্রাটি হবে একযোগে, তখন গোটা বাংলাদেশ হেসে উঠবে আনন্দে, জয়োল্লাসে। জয়ী হবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি। বিষণ্নতার গুমোট বাষ্পটি উবে যাবে লক্ষ কোটি তরুণ-তরুণীর মন থেকে। অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও। মঙ্গল শোভাযাত্রা গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে এক সর্বজনীন মাঙ্গলিকতাও ছড়িয়ে পড়বে।
 
আমাদের তরুণরা বাঁচার মন্ত্র যদি পায়, যদি পায় ভালোবাসবার দীক্ষা, যদি পায় আনন্দ, যদি পায় স্বপ্ন দেখার সুযোগ তাহলে কেন তারা অন্যকে মারতে যাবে? কেনই বা যাবে মরতে? যে মরে সে তো স্বপ্নহীন বিষণ্ন। মনে যার স্বপ্ন নেই, আনন্দ নেই, সুখ নেই সে-ই পারে মারতে আর মরতে। যার জীবনে স্বপ্ন থাকে, ভালোবাসা থাকে সে মারে না, নিজেও মরে না।
 
আমাদের তরুণদের ধ্বংস ও মরণের নারকীয় পথ থেকে ফেরাতে হবে। দেখাতে হবে বাঁচার স্বপ্ন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো সর্বজনীন উৎসব আমাদের তরুণদের মনের আনন্দহীন গুমোট ভাবটি সরিয়ে ভালোবাসতে শেখাবে। তারা দেখতে পাবে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি কতো উদার, মানবিক, আর সহিষ্ণু। যখন সেই ধারায় তাকে দীক্ষিত করা যাবে তখন সে আর আগুনে ঝাঁপ দেবে না। ।
 
আমাদের যে ঐতিহ্য তা মূলত প্রাণে প্রাণ ‘মিলিবার-মেলাবার’। হিংসা ও বিভাজনের নয়। রাম-রহিম-ডেভিড-বড়ুয়া-চাকমা-তঙচঙ্গা, খাসিয়া-গারো-মুরং-মারমা সবাই এদেশে শত শত বছর ধরে নানান বর্ণ, গণ্ধ, উদ্ভাস ও বৈচিত্র্য মিশিয়ে সম্প্রীতির অভিন্ন এক মালা গেঁথেছে। একসঙ্গে গলাগলি করে থেকেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সেই অভিন্নতার, প্রেমের মন্ত্রকেই বড় করে তুলবে। দীক্ষা দেবে মিলনের, মহানুভবতার।  সবাইকে মেলাবে এক তারে; অভিন্ন মাঙ্গলিক আবাহনে।
 
অসুর দমনের জন্য চাই আরও বেশি সুর ও ছন্দ। চাই দিকে দিকে শুভবোধ, মঙ্গলব্রতের উদ্বোধন। সেটাই করতে হবে এখন। মানে ফিরতে হবে ঐতিহ্যের শেকড়ে। নিজের ইতিহাসের কাছে, সংস্কৃতির কাছে। যা মিলতে আর মেলাতে শেখায়। অন্যকে আপন করতে শেখায়। হিংসার বদলে ভালোবাসতে শেখায়। সবার অংশ হতে শেখায়।
 
তাই অবগাহন করতে হবে নিজের আবহমান সংস্কৃতির ফল্গুস্রোতে। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে শুরু হোক শেকড়ের দিকে যাত্রা: উজ্জীবনের দিকে যাত্রা। বৈশাখের প্রথম সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাতে সর্বজনীন ভালোবাসায়, প্রেমে, প্রীতিবোধে ও সংরাগে হেসে উঠুক আমাদের যৌথ জীবন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৭
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।