ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সম্পাদকীয়

বিশেষ সম্পাদকীয়

তিনি কি কেবল অভিজাত এলাকাবাসীর মেয়র?  

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৭
তিনি কি কেবল অভিজাত এলাকাবাসীর মেয়র?   বিশেষ সম্পাদকীয়

অবশেষে তার টনক নড়ল। ‘আপনার ঘরের ভেতরে গিয়ে আমি মশারি খাটাতে পারব না। আপনার ছাদের ওপরের চৌবাচ্চায় আমি ওষুধ লাগাতে পারব না। আপনার ঘরের ভেতরে যে সামান্য স্বচ্ছ পানিতে মশা জন্মেছে, সেটা আমি মারতে পারব না’ ---ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নাগরিকদের তাচ্ছিল্য করে দেওয়া বেফাঁস মন্তব্যের জন্য দু:খপ্রকাশ করলেন মেয়র আনিসুল হক। তার এহেন বক্তব্যটি কোনোভাবেই শোভন ছিল না, কাঙ্ক্ষিতও ছিল না;বরং তাতে যে ছিল স্পষ্ট অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্য। একদিন পর তিনি তা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।
 

কেননা নাগরিকরা তার এই মন্তব্যকে ভালোভাবে নেননি। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া, কড়া সমালোচনা হতে থাকে।

স্বাভাবিকভাবেই মেয়রের দায়িত্বশীলতা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তোলেন বিক্ষুদ্ধ ও ভুক্তভোগী নাগরিকরা। যাদের করের টাকায় তার কর্পোরেশন চলে, সেই করদাতা নাগরিকদের প্রতি জনপ্রতিনিধির চরম তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাসূচক বক্তব্যে সর্বত্র নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। বয়ে যাবারই কথা! ফলে একদিনের মধ্যেই নিজের কথা গিলে নিতে হয় মেয়র আনিসুলকে। দু:খপ্রকাশ তিনি করলেন অবস্থা বেগতিক দেখে। বলা যায়, করতে বাধ্য হলেন।

এভাবে নাগরিকদের ক্ষোভের আগুনে আপাতত কিছুটা জল ঢালতে পেরেছেন তিনি। তবে মেয়রের এই দু:খপ্রকাশ কতোটা আন্তরিক সে প্রশ্নটিও উঠবে। কেননা মেয়র যখন বলেন, ‘এ জন্য কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমরা তার জন্য দুঃখিত। ’তার এই ‘যদি’ শব্দেই বোঝা যায় নাগরিকরা কষ্ট পেয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি এখনো নিশ্চিত নন।
 
শুধু মশা বা চিকুনগুনিয়া নিয়েই ক্ষোভ শেষ হবার নয়। নাগরিক দুর্ভোগ আরও বহুক্ষেত্রেই ক্রনিক রূপ নিয়েছে। সেসব দুর্ভোগজনিত ক্ষোভ এতো সহজে প্রশমিত হবারও নয়। সেকথায় পরে আসছি।
চিকুনগুলিয়ার জন্য সিটি করপোরশেন দায়ী নায়
একজন সাংবাদিক চিকুনগুনিয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই মেয়র আনিসুল যেভাবে নগরবাসীকে ‘হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলেন’ (পড়ুন‘মশারি দেখিয়ে দিলেন’), তা রীতিমতো বিস্ময়কর, আপত্তিকর। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার কাছ থেকে এমন আচরণ মোটেই কাম্য নয়। তিনি কষ্ট লাঘবের বদলে নাগরিকদের ক্ষতে খোঁচা দিয়েছেন। অথচ ঢাকা উত্তরের নগরপিতা তিনি। নগরপিতার আচরণ এমন কেন হবে!
 
ঘরে ঘরে গিয়ে মশারি টাঙ্গিয়ে দেবার প্রয়োজনই পড়তো না, যদি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নিজের কাজটি ঠিকভাবে করতো। যদি নিয়মিতভাবে মশক নিধন করতো। ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতো। তরল আর কঠিন বর্জ্যে উপচানো ড্রেনগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয়নি বলেই তো মশা সেখানে নিরুপদ্রবে বংশ বিস্তার করেছে। ঢাকার বিরাট এলাকা হয়ে উঠেছে মশার অভয়ারণ্য বা ডিপো। আর সে কারণেই মশাবাহিত মহামারী চিকুনগুনিয়ার করাল ছোবলে ধুঁকছেন আজ নাগরিকরা।  চিকুনগুনিয়া আজ ঘরে ঘরে। প্রতি ১১ জনের একজন আজ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের চিকিৎসার ভার বহন ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছেন কর্পোরেশনকে। মেয়র আনিসুল আদালতের এই তাগিদের ব্যাপারে একেবারেই ‘স্পিকটি নট’।
 
মেয়র মশক নিধনে তার গৃহীত নানা কার্যক্রমের ফিরিস্তি টানলেও নগরবাসী সেসবের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান। মানে, কাজীর গরু এক্ষেত্রে কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ধুলারে করিয়া দিতে দূর /জগৎ করিল ধুলায় ভরপুর’;  উত্তর সিটি কর্পোরেশন এমনই কার্যক্রমই এতোদিন ধরে চালিয়েছে যে, অনায়াসেই প্যারোডি করে বলা চলে: মশারে করিয়া দিতে দূর/শহর করিল মশায় ভরপুর।

মশা তাড়াতে আগেভাগেই যদি সঠিক কার্যক্রম চালানো হতো তাহলে আজ আর চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ঘোষণা করতে হতো না। মশার সামাজ্য বিস্তার করতে দেবার পর মেয়র যখন বলেন, ‘সমস্ত শক্তি দিয়ে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ করা হবে’ তখন তা অসার উক্তির মতো কানে বাজে। এ যেন অনেকটা ‘রোগী মারা যাইবার পর ডাক্তার আসিল’-র মতো ব্যাপার!
 মেয়র গুলশানে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে শোভাযাত্রা করেছেন ভালো কথা!কিন্তু গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার বাইরে গিয়ে শোভাযাত্রাটি করলেই তিনি বুঝতেন উত্তর সিটির অন্যসব এলাকার রাস্তাঘাটের কী করুণ হাল! এসব রাস্তার গর্ত, খানাখন্দ আর খোঁড়াখুঁড়ির চলমান মোচ্ছব কি তার চোখে পড়ে না? চাঁদ আর মঙ্গলগ্রহের এবড়ো খেবড়ো পৃষ্ঠদেশকে লজ্জা দিতে পারে অভিজাত এলঅকার বাইরের সব এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি। মাসের পর মাস ধরে চলা গর্তময় রাস্তাগুলো মেরামতের তাগিদ নেই কোনো। নিদেনপক্ষে গর্ত ভরাটের কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে না। উত্তরের মেয়র কি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সামান্য তাগিদ দিয়েছেন?উদ্যোগী হয়েছেন?
 
মেয়র হিসেবে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, তিনি শুধু অভিজাত এলাকার দিকেই মনোযোগী। সেখানকার রাস্তাঘাটসহ সবকিছু ঝকঝকে তকতকে রাখাতেই তার সব মনোযোগ। অন্যসব এলাকার প্রতি তার মনোভাব বিপিতাসুলভ। নাগরিকদের এসব অভিযোগের পক্ষে প্রমাণও মিলবে বিস্তর। দেখতে পাবেন অভিজাত এলাকার বাইরে গেলেই---‘...ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া!’
 
গুলশান, বনানীর বাইরের অন্যসব এলাকার প্রতি কেন তিনি এতো উদাসীন? এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ তাহলে কে দেখবে? শুধু অভিজাত এলাকার নাগরিকেরাই কি কর দেন? অন্যরা দেন না?
 
একদিকে গুলশানের ঝকঝকে রাস্তায় যখন নতুন করে কার্পেটিং হয়, শ্রীবৃদ্ধি হয়, অন্যদিকে আশপাশের অন্যসব এলাকায় এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় চলতে গিয়ে নাগরিকদের নাভিশ্বাস ওঠে। তাহলে কি তিনি কেবল অভিজাতদের মেয়র? অন্যসব এলাকায় পুরো রাস্তাজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির নরক। রাস্তাজুড়ে হাজার হাজার খানাখন্দ গর্ত। সেসব গর্ত ভরাট করা হয় না দিনের পরদিন, মাসের পর মাস। সেখানে খোঁড়াখুঁড়িজনিত আবর্জনা, জঞ্জাল ফেলে রাখা আছে দীর্ঘদিন ধরে। গাড়ি যে চলবে তার কোনো উপায় নেই। তবু উপায়হীনতার মধ্যেই উপায় খুঁজে চলছে গাড়িঘোড়া।
 
ঢাকা উত্তরের বিপুল জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়র আনিসুল হকের অবদান কোথায়? ড্রেনগুলো থেকে কালেভদ্রে ময়লা আবর্জনা ওঠানো হলেও সেগুলো আর খুব একটা সরানো হয় না। ফলে সে আবর্জনা আবার গিয়ে পড়ে ড্রেনে। মাঝখান থেকে অসৎ কর্মকর্তারা ভুয়া বিল তুলে নিজেদের পকেট ফোলাতেই ব্যস্ত। মেয়র আনিসুল কি এসব দেখতে পান না? কেন জলাবদ্ধতা হয় সেসব কারণ কি তার জানা নেই? দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধারে তার উদ্যোগ বা ভূমিকা কোথায়?
 
এসব দুর্ভোগের দিকে না তাকিয়ে বেশ কিছুদিন তিনি ব্যস্ত থাকলেন অভিজাত এলাকার রাস্তা প্রশস্ত করার কাজে। কাটা হলো অনেক গাছ। একটা কাটা গাছের স্থলে একাধিক গাছ লাগানোর যে অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি, তা কি পূরণ করেছেন? কয়টি গাছের চারা তিনি লাগিয়েছেন বড় বড় গাছ কেটে ফেলার পর?
 এসব প্রশ্ন, এলাকাকেন্দ্রিক বৈষম্যের এসব অভিযোগ কী করে এড়াবেন নগরের একাংশের পিতা আনিসুল হক? নগরপিতা হিসেবে এসব অভিযোগের কি জবাব দেবেন তিনি? দেবার মতো জবাব কি আছে আদৌ তার? 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।