ঢাবি: ১৯৪৯ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ন্যায্য দাবিতে নামলেন আন্দোলনে।
সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল আইন বিভাগের সেই শিক্ষার্থীসহ ছয় ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করে এবং ১৫ টাকা জরিমানা করে। এছাড়া এই ছয় শিক্ষার্থীকে ‘ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করবো’ এমন মুচলেকা দিতে সময় বেঁধে দেয়। বাকিরা মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও আইন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অন্যায় আদেশ না মেনে বহিষ্কার হন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পরবর্তীতে সেই আপোষহীন তরুণ পরিণত হন বাঙালি জাতির সব প্রেরণার উৎস। স্বাধিকার আদায়ের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছিলেন বিদ্রোহের অনির্বান। ৫২’ ভাষা আন্দোলন, ৬২’শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বোপরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য সাধারণ ভূমিকার রেখে তিনি পরিণত হন বাঙালি জাতির মহানায়কে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর মতোই দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা রাখেন সর্ব্বোচ্য ভূমিকা। ছাত্র-শিক্ষকদের সেই সম্মিলিত প্রয়াস আজও অব্যাহত রয়েছে।
১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় পা দিয়েছে ৯২ বছরে। ১৯২১ সালের এই দিনে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। আজ (রোববার) বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তার গৌরবোজ্বল ইতিহাসকে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে নিয়ে পালন করছে ৯১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
কেবল আন্দোলন সংগ্রাম নয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে জ্ঞান চর্চার পাদপীঠে পরিণত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। উপমহাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে অর্জন করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি।
সুনাম ধরে রাখতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবিদদের মতে, অতীতের অর্জনের ধারবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দিন-দিন ম্রিয়মান হচ্ছে এর সাফল্যের আলোকচ্ছ্বটা। শিক্ষা গবেষণায়র যে সাফল্যের উজ্জ্বল ইতিহাস তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। ফলে পিছিয়ে পড়ছে ওয়াল্ড র্যাংকিংয়ে।
মানুষের অধিকার আদায়রের রাজনীতির যে সুনাম ছিল, তাও আজ হারিয়ে গেছে দলবাজির অতল গহ্বরে। গৌরবের ছাত্র রাজনীতি আজ শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপ। দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতিতে অস্থির সবুজ ক্যাম্পাস বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
তাদের মতে, শিক্ষকরা ও জড়িয়ে পড়ছেন নোংড়া রাজনীতিতে। নীল, সাদা কিংবা গোলাপী রঙে বিভিক্ত হয়ে লেজুড়বৃত্তি করে পেছনে ঠেলে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। পাঠদান কিংবা গবেষণা রেখে অর্থ উপার্যনের দিকেই শিক্ষকদের মনোযোগ। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ, পছন্দের শিক্ষার্থীকে বেশি নাম্বার প্রদান, অর্থলোভে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে অগ্রাধিকার দেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত হচ্ছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশও নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। আবাসিক হলগুলিতে চরম আসন সংকট। আবাসনের বিনিময়ে ছাত্রদের অংশ নিতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে।
শিক্ষার্থীদের কথা বলার জায়গা নেই
শিক্ষার্থীদের কথা বলার অধিকার কমছে দিন দিন। দীর্ঘ ২২ ধরে হচ্ছে না ডাকসু নির্বাচন। সিনেট-সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। ফলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকারের জায়গাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ডাকসু নির্বাচনের অঙ্গীকার করলেও কেউই তা রাখেননি।
খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সুনামও ধরে রাখতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি। ক্রিকেট, ফুলবল, হকিসহ বিভিন্ন ধরনের খেলার জাতীয় পর্যায়ে ছিল এর আধিপত্য। এখন তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও আগের সাফল্যেও ধারবাহিকতা নেই।
এসব সমস্যাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই প্রেরণা নিয়ে আজ পলিত হবে `ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস`। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য `নারীর ক্ষমতায়নে উচ্চশিক্ষা`।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। ’
তিনি বলেন, ‘সীমিত সুযোগের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক মানের সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। ’
বিভিন্ন সমস্য অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় সমনে এগেয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের এক টেলিভিশন প্রোগ্রামে বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বলেন, জাতির বিভিন্ন দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে। সব আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার এই বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমানেও অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বিশ্ববিদ্যালয়। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আবু নোমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে। সাজাতে হবে নতন পরিকল্পনা। বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, গবেষণা ও রাজনীতিতে পিছিয়ে যাবে বহুদূর। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১২
এমএইচ/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর