জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলো কিছুদিন আগে পর্যন্ত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই এটাই ভাবতেন।
একটি ঘটনা সব চিত্র বদলে দিলো, আমরা ভাবতে এবং বুঝতে শুরু করলাম যে আমাদের এই পরিচিত প্রতিষ্ঠানটি দেখতে দেখতে চল্লিশ বছর পার করে ফেলেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার পরিসমাপ্তি হলো আরো একটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার মাধ্যমে। আমরা অনেক আন্দোলনের ফসল হিসেবে একজন অনির্বাচিত উপাচার্যের পরিবর্তে আরেকজন অনির্বাচিত উপাচার্য পেলাম। প্রথমজন নিজের বাড়ির হলেও পরেরজন পাশের বাড়ির যে বাড়ির সাথে আমাদের একটা ইগো সমস্যা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এই লেখায় আমি বিচার করতে যাব না ইগো সমস্যা যৌক্তিক কিনা বা এটা কিভাবে এসেছে, আমি শুধু জাবির বর্তমান প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ থাকবো।
শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রতি যে আমাদের উদাসীনতা আছে এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই উদাসীনতা যেন দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। একজন জাতীয়ভাবে পরিচিত শিক্ষককে নিয়ে জাতীয় প্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদে কথাবার্তা এবং যেসব শিক্ষক আমাদেরকে হাতে কলমে পড়তে লিখতে শিখিয়েছেন তাদের রাস্তায় পিটানো আমাদের উদাসীনতারই নতুন প্রমাণ। কিন্তু এটা অতিশয় হতাশাজনক একটা ব্যাপার। যারা এই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চান তাদের জন্য এটা অনেক বড় একটা বাধার যায়গা। তাহলে কি মানুষ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে? উত্তরটি আমার জানা নেই এবং কে এর উত্তর দিতে পারবেন তাও জানি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবো এইরকম একটা সিদ্বান্ত নেওয়ার সময় ভেবেছিলাম শিক্ষক হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে এবং সেগুলো পালন করার নামই শিক্ষকতা। কিন্তু বর্তমান বাস্তব ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত দেয় যা অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জার। শিক্ষক হিসেবে রাজনীতি আমি করবোনা বা রাজনীতি সচেতন থাকবো না এমন কোন মুচলেকা আমরা কাউকে দেই না বা আমাদের দিতে হয় না। গর্ব করে বলে থাকি, ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী চাকরি করছি, সুতরাং অনেক স্বাধীন। এই স্বাধীনতা উপভোগ করতে করতে আমরা কিভাবে যেন অনেক আগেই ভুলে গেছি যে নিজের স্বাধীনতা মানে এই নয় যে অন্যকে পরাধীন করে তোলা।
জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকালে দেখি, যেই দলই বিরোধীদলে থাকুক না কেন, কিছুদিন পরই একটা সুর তোলে যে এই সরকার খারাপ এটাকে গদি থেকে নামাতে হবে। না নামলে টেনে হিচঁড়ে নামানো হবে। আমার কথা হলো এইটা বলাটা কতটা সাংবিধানিক? অন্যভাবে বলতে গেলে এইটা বলাটা কতটা সাংবিধানিক হওয়া উচিত? একটা সরকার ক্ষমতায় আসে সাংবিধানিক উপায় মেনে এবং আমি সাংবিধানিক শর্তাবলী পূর্ণ হওয়ার আগেই বলি যে সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে গদিচ্যুত করতে হবে। মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার মধ্যে কি এগুলো পড়ে? আমাদের মতো গরীব দেশ কি এগুলো হজম করার ক্ষমতা রাখে? এইটা হলো মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে দেখি সরকারিদল বিরোধীদলের কোন দাবিকেই পাত্তা না দিয়ে যা ইচ্ছে তা করে যায়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দিন দিন জাতীয় রাজনীতির সুরের সাথে সুর মিলিয়ে চলছে। আমরাও একজন উপাচার্যকে কোনো স্পেস দিতে চাই না, কথায় কথায় তার পদত্যাগের মতো বড় দাবি করে ফেলি। প্রয়োজনে নিজর অনুগত ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যাবহার করতে পিছপা হই না। আমাদের ছাত্র/ছাত্রীরা স্লোগান দেয় ‘এক দফা এক দাবি, ভিসি তুই কবে যাবি?’ অথবা ‘হৈ হৈ রৈ রৈ, ভিসি তুই গেলি কই?’। এই স্লোগানগুলো আমার কাছে অত্যন্ত অশ্রাব্য মনে হয় যখন আমি তা আমারই প্রিয় ছাত্র/ছাত্রীদের মুখে শুনি। উপাচার্য পদটি অত্যন্ত সন্মানের এবং একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ। এই পদটিকে এইভাবে অপমান করার অধিকার আমরা রাখি কি? আমাদের এইসব কোমলমতি ছাত্র/ছাত্রীরা রাখে কি? এমন স্লোগান দিচ্ছিলো এমন কিছু ছাত্র/ছাত্রীদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওদের কেউ কেউ আমার সাথে সন্মতি প্রকাশ করলো, কেউ কেউ বললো যে এরচেয়ে ভাল মিলের স্লোগান তারা পায়নি, কেউ কেউ বলেছে, তাদের এই স্লোগানটিই দিতে বলা হয়েছে। এটা পরিবর্তন করে সন্মানজনক কিছু বলা যায় কিনা জিজ্ঞেস করলে কারো মুখ থেকে কোন কথা বেরোয়নি। আমি কষ্ট পেয়েছি এই ঘটনায়। কারণ প্রথমত আমি ভাবছিলাম আমি এদেরকে ক্লাশে পড়াবো কি করে, কারণ যারা উপাচার্য পদটিকে গালি দিতে অভ্যস্ত তারা আমাকে তো গোনাতেই ধরবে না। দ্বিতীয়ত, এই যে ছেলেমেয়েগুলো না বুঝেই কিছু স্লোগান আজকে দিচ্ছে, এর প্রভাবটা তাদের ওপড়ে কিভাবে পড়বে যখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা কি করেছিলো। এরা যদি তখন কোনো হতাশায় পড়ে, তার দায়ভার কে নেবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, অনেক আর্মস ক্যাডার পরবর্তীতে লম্বা পাঞ্জাবি পরে ইসলামের দাওয়াত দিতে রুমে রুমে এসেছে। আবার অনেকে এর চেয়েও বেশি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দুঃখ লাগে যে এই স্লোগানগুলো অনেক বড় বড় সন্মানিত শিক্ষকদের সামনেই দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সন্মানিত শিক্ষকরা ওদের থামাননি।
অন্যদিকে উপাচার্যকেও তার পদ আঁকড়ে থাকতেই হবে, এতে কার কি ক্ষতি হচ্ছে তা দেখার দরকার নেই। উপাচার্যকে আরো বিপদে ফেলার জন্য আমাদের সন্মানিত শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় পত্র/পত্রিকায় বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। কেউই কোনরকম সংযমের ধার ধারেননি। এরা সবাই হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন যে এই সমস্ত কেচ্ছা কাহিনীর পরেও এদেরকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরেই আবার হাঁটতে হবে। অন্যথায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় যা গড়ে উঠার কথা ‘শেখা এবং শেখানো’ থিমের ওপড় ভিত্তি করে সেখানে এগুলো হয় কি করে? প্রশ্নটা বার বার মনে এলেও কোন উত্তর পাই না।
বাস্তবতা হলো আমরা আসল থিম থেকে অনেক দূরে সরে গেছি এবং যার ফলে আমার বাসার সমস্যা দূর করার জন্য আমার পাশের বাসা থেকে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হলো যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করতে সময় নেবেন অনেকদিন। এটা কি কোন বাস্তবসন্মত সিদ্ধান্ত হলো কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমরা যদি ইরাক বা আফগানিস্তানের দিকে তাকাই আমরা দেখি যে পাশের বাড়ির কাউকে দিয়ে সমস্যা সমাধান হয় না।
এরকম একটা সিদ্বান্ত জাবি পরিবারকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছে। এতগুলো মানুষের অনুভুতিতে আঘাত দেয়ার আগে আমার মনে হয় সরকারকে আরেকবার ভাবা উচিত ছিলো। নতুন উপাচার্য এবং তার যোগ্যাতা সম্পর্কে আমার মনে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু উনাকে এই ভূমিকায় জাবিতে আশা করিনি। একইসাথে জাবি পরিবারের বিভিন্ন গোত্র প্রধানকে অনুরোধ করবো তাদের ভূমিকা সম্পর্কে যত্নবান হতে। কারণ নতুন উপাচার্য অনেকের অনুভূতিকে আঘাত করে টিকে থাকার পরে ফিরে যাবেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আপনারা যাবেন কোথায়? আপনারা অবশ্যই চাইবেন না আপনাদের বাকি সমগুলোতে জাবি পরিবার আপনাদের বাকা চোখে দেখুক। আপনাদের মনে রাখা উচিত হবে যে জাবি পরিবারটি এখন অনেক বড় এবং এটার ভালমন্দ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এই পরিবারের সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করতে পারলেই আকাংখিত সাফল্য দ্রুত ধরা পড়বে। আমি বর্তমান উপাচার্য মহোদয়কেও একইভাবে সবার সাথে কথা বলে ভালো-মন্দ বুঝে নেয়ার অনুরোধ করবো। তবে সাথে এটাও বলবো আলোচনা দীর্ঘায়িত করলেই যে ভালো সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে, এমন কোন কথা নেই। দীর্ঘায়িত আলোচনাকে যেন আমাদের কালক্ষেপণ হিসেবে আখ্যায়িত না করতে হয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন- হেড অব নিউজ