ঢাকা: অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর প্রদান সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে নির্দেশনা দিতে রাষ্ট্রপতি ও দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. সাহাবুদ্দিনকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ গত এক যুগের পথ পরিক্রমায় সমগ্র বিশ্বে উন্নয়নের একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাঙালি জাতি আজ উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে ‘রূপকল্প ২০৪১: উন্নত বাংলাদেশ’ অর্জনের স্বপ্ন লালন করছে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত জনবল তৈরির মাধ্যমে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। মাত্র তিন দশকের পথ চলায় আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জন ও অবদান দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক সাফল্যের পাশাপাশি বিরাজমান কিছু সমস্যার যথাযথ সমাধান এ খাতের অগ্রযাত্রাকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে বিশ্বাস করি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে আপনার সদয় অবগতি, দিক নির্দেশনা ও সহযোগিতার নিমিত্বে সবিনয়ে জানাচ্ছি যে অতি সম্প্রতি অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত ২০২১ সালে করা রিট আপিলের নিষ্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আয়কর প্রদানের আওতাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং এ খাতে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের বিশদ বিবরণ আদেশের পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রকাশের পরে জানা যাবে মর্মে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০০৭ ও ২০১০ সালে পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীর করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়কর আদায়ের দুটি প্রজ্ঞাপন অবৈধ বলে রায় দেন। এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের অধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ট্যাক্স-ভ্যাটের আওতামুক্ত বিধায় ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা রহিত করা হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ (ধারা-১৫) অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উক্ত আইনের ৪৪ (৭) ধারা অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশে ব্যয় করা যাইবে না’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায়, আয়কর প্রদানের নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়কে উভয় সংকটে ফেলবে। কেননা, প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের কোনো রূপ অর্থ উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতারা যেমন গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি আয়কর হিসেবে দেওয়া বা অন্যভাবে ব্যয় করার বিষয়টিও সরাসরি আইনের লঙ্ঘন হিসেবেই প্রতীয়মান।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো সরকারি অনুদান ব্যতিরেকে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিস এবং সংকটকালীন ট্রাস্টি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে অর্থ সংকটের কারণে নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনের জন্য অখণ্ড জমি কেনা, ক্যাম্পাস নির্মাণ করা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনিতেই ক্যাম্পাস নির্মাণ সামগ্রীসহ শিক্ষা সামগ্রী, ল্যাবের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কেনার ওপর সরকারি ভ্যাট/ট্যাক্স দিতে হয়। ওপরন্তু আয়কর আরোপ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন কাজ বিঘ্নিত তথা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হ্রাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-ট্রাস্টিরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সব বিধিবিধান মেনে পরিচালিত। এক্ষেত্রে ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত সব প্রতিষ্ঠানই করের আওতামুক্ত। ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপ আইনতগতভাবে সাংঘর্ষিক হয়। করারোপের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনার নজির উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ, ব্রিটেনের কনভেনটি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার টোরেন্স ইউনিভার্সিটি লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আদায় করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করে। ফিলিপাইন ও চীনে লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয়। ভারতেও এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনে লাভজনক ও অলাভজনক উভয় পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমোদন বিবেচনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আইনী জটিলতা পরিহার করা সম্ভব বলে মনে করি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের পাশাপাশি মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার তথা শিক্ষিত জাতি গঠনে অবদান রেখে চলেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী একসাথে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা হ্রাসের পাশাপাশি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশে আসছে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী তৈরিসহ জনগোষ্ঠীকে জন সম্পদে রূপান্তর করার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা খাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান তথা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর করারোপ সংক্রান্ত আইনগত জটিলতা নিরসন ও সুষ্ঠু সমাধানে আপনার সদয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শের জন্য বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনার সদয় সহযোগিতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চলমান সংকট নিরসনে বিশেষ সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২৪
এমআইএইচ/এসআই
--