ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বাণিজ্য আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চা! বিপাকে অভিভাবকরা

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১২
বাণিজ্য আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চা! বিপাকে অভিভাবকরা

ঢাকা: উন্নত শিক্ষার নামে দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করালেও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব স্কুলে শিক্ষার নামে চলছে বাণিজ্য।

আর বিদেশি সংস্কৃতির নামে হচ্ছে অশ্লীল সাংস্কৃতিক চর্চা।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আদলে গড়ে ওঠা এসব স্কুলের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো নীতিমালা না থাকায় নানা অজুহাতে অর্থ আদায় করছে তারা। অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধেও নেই কোনো উদ্যোগ।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মাধ্যমে সুনাগরিক তৈরি হচ্ছে না। আধুনিক শিক্ষার নামে দেশিয় সংস্কৃতি থেকে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তারা। বিদ্যমান সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।

তবে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, শিক্ষার নামে কাউকে বাণিজ্য করতে দেওয়া হবে না।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীতিমালা না থাকায় একেক প্রতিষ্ঠান ভর্তিতে একেক রকম ফি নিচ্ছে। এছাড়া নিয়ম ভাঙ্গার অভিযোগে বছরে অনেক শিক্ষার্থীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। বহিষ্কারের কারণ হিসেবে জানা যায়, বহিস্কারের পর আসন খালি হলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে আবেদন করলেও কোন কাজে আসছে না। এক্ষেত্রে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা।

অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলগুলোতে ইচ্ছেমতো বেতন, বছরজুড়ে নানা অজুহাতে ফি, ক্যান্টিনে গলাকাটা দাম, রয়েছে নির্ধারিত টেইলর। অথচ লেখা-পড়ার মান নেই, নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। খেলার মাঠ নেই। বিদেশি শিক্ষক দেখিয়ে কোথাও ভর্তি করালেও পরে আর দেখা যায় না। শিক্ষকদের টিস্যু পেপার পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের কিনে দিতে হয়।

অভিভাবকদের অভিযোগ, তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করেও কাংখিত কোনো ফল পাচ্ছেন না। সরকার এসব স্কুল মনিটরিংয়ে উদাসীন।

রাজধানীর বারিধারায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা’র (আইএসডি) বেতন-ভাতা প্রদান করতে হয় মার্কিন ডলারে। এখানে প্লে গ্রুপের একজন শিক্ষার্থীর ছয় মাসের টিউশন ফি বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪০ টাকা। নার্সারিতে এই ফি প্রায় ৩ লাখ, প্রি-কেজিতে সোয়া ৫ লাখ, কেজি থেকে গ্রেড টু পর্যন্ত সোয়া ৭ লাখ টাকা। ছয় মাস পরপর এই ফি দিতে হয়। তাছাড়াও মাসিক বেতন এবং টিউশন ফি’র বাইরে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভর্তি ফি, বার্ষিক ফি, প্রযুক্তি ফিসহ নানা ধরনের ফি তো আছেই।

ধানমন্ডির সানিডেল স্কুলে প্লে শ্রেণির ভর্তি ফি ৭২ হাজার, আর মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা। অষ্টম শ্রেণির ভর্তি ফি দেড় লাখ, মাসিক বেতন ৮ হাজার টাকা।

উত্তরার ডিপিএস এসটিএস স্কুলে শুরুতে গ্রেড ওয়ানে ভর্তি ফি আদায় করা হতো ৭৫ হাজার টাকা। ২০১২ সালে সে ফি বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

স্কলাস্টিকা স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি নেওয়া হয় ৮০ হাজার টাকা। পরের শ্রেণিতে ভর্তির বার্ষিক সেশন ফি ২২ হাজার টাকা।

এছাড়াও টার্কিশ হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি ৭০ হাজার টাকা। সী ব্রিজ স্কুলে কেজিতে ভর্তি ফি ৪৫ হাজার। মাসিক বেতন সাড়ে ৪ হাজার। স্যার জন উইলসন স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি ফি ৩৭ হাজার টাকা। আর মাসিক বেতন সাড়ে ৯ হাজার টাকা।

সানিডেল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তৃণা ও রাজুকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে বছরের মাঝামাঝি স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। অভিভাবকরা স্কুলের ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে আবেদন করলেও কোনো ফল পাননি। এই স্কুল থেকে প্রতি বছর ১০/১৫ জন শিক্ষার্থীকে বিনা কারণে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে অভিভাবকরা অভিযোগ তোলেন।

বহিষ্কারের উদ্দেশ্য ও কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক অভিভাবক বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে নতুন ভর্তি হতে হলে দেড় লাখ টাকা ফি দিতে হয়। পুনঃভর্তি হলে দিতে হয় ১৪ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে অভিযোগ দেওয়ারও কোনো স্থান নেই। এ বিষয়ে নীতিমালা করা দরকার।

সানিডেল স্কুলের প্রিন্সিপাল তাজিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এবিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।

স্কুলগুলোর পরিচালনার নীতিমালা না থাকায় নির্ধারিত ফি দিয়ে শিক্ষা বোর্ড থেকে নামে মাত্র রেজিস্ট্রেশন করে পরিচালিত হয়। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাতে চলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা, পাঠ্যবই ইত্যাদি নির্ধারণ। অথচ ক্যামব্রিজ, এডেক্সেল ও অস্ট্রেলিয়ানসহ আন্তর্জাতিক মানের স্কুলগুলোর নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষাক্রম পরিচালিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না।

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ফাহিমা খাতুন বলেন, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের কার্যক্রম এবং শিক্ষাক্রম পরীক্ষা ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে নেওয়া হলেও সত্যিকার অর্থে কোন বই পড়ানো হচ্ছে, বাংলাদেশের কিছু পাঠ্য আছে কি না, শিক্ষার্থীদের বেতন কাঠামো কেমন তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য নীতিমালা প্রনয়ণ খুবই জরুরী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিশিষ্টজনদেরও উদ্বেগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে। শনিবার এক অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ বলেন, শিক্ষার নামে কিছু প্রতিষ্ঠান অর্থ-বাণিজ্যে লিপ্ত। তাদের জন্য আগামী প্রজন্মের ভবিষৎ অনিশ্চিয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো মুনাফার জায়গা নয়। শিক্ষা নিয়ে কাউকে বাণিজ্য করতে দেওয়া হবে না।

তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে কোনো হেলাফেলা সহ্য করা হবে না। বরদাশত করা হবে না মানসম্মত শিক্ষার নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্য বা কোচিংবাণিজ্যও।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১২
এমআইএইচ/সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।